সোমবার | ২ জুন, ২০২৫ | ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

মেঘনার জলজ সম্পদ ‘পংকজ’ খেয়েছেন হাঙরের মতোই

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ইলিশের বেশির ভাগই মূলত মেঘনা নদী থেকে আসে। স্বাদে ও পুষ্টিতে মেঘনার ইলিশ শুধু দেশের মধ্যেই নয়, বিশ্বসেরা। আর সেই মেঘনা নদীর ২২ কিলোমিটার অংশ প্রবাহিত হয়েছে বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে। মেঘনার এই অংশের পুরোটাই ইলিশের অভয়াশ্রম।

ইলিশ সিন্ডিকেট পাকাপোক্ত করতে মেঘনাতীরের এই অভয়াশ্রম ঘিরে অন্তত ১৫০টি টংঘর স্থাপন করেছিলেন বরিশাল-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য পংকজ নাথ। পুরো নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও চালাতেন বেপরোয়া ইলিশ ধরা ও কেনাবেচা। মেঘনার বালু ছিল তাঁর গড়া সিন্ডিকেটের বিশাল আগ্রহের বিষয়। নজর ছিল হাজার হাজার একর চরাঞ্চলের প্রতিও।

এক যুগ ধরে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের সব কিছুই পংকজ নাথের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল। হাঙরের মতোই মেঘনার জলজ সম্পদ খেয়ে ফেলতেন তিনি। নদী-চর নিয়ে্ত্রণ রাখতে পংকজের অনুসারীদের হাতে আট বছরে আওয়ামী লীগেরই ১৩ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। পংকজ নাথের দাপটে শুধু বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা তটস্থ থাকতেন না; দলীয় লোকজনও তাঁকে সমীহ করে চলতেন।

বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এলাকায় গিয়ে পংকজ নাথের ক্যাডারদের হামলার শিকার হয়েছিলেন। তবে একসময় ক্যাসিনোকাণ্ডে ফেঁসে যান পংকজ নিজেই, এমনকি দলীয় পদও হারান। আবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকেও বঞ্চিত হন। কিন্তু তাঁর দাপটে নৌকার প্রার্থী নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়েন। ফলে খোলা মাঠেই পংকজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে গোল দেন।

মাছঘাট থেকেই আসে ২০০ কোটি : ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে প্রতিবছর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকে। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর আবার ২ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন জাটকা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পংকজ নাথের ‘ইলিশ সিন্ডিকেটে’র সহযোগিতায় ইলিশ শিকারের মহোৎসব থাকত মেঘনাতীরে। জেলেরাও এই উৎসবে অংশ নিতেন। কারণ গ্রেপ্তার কিংবা জেল-জরিমানার বিষয়টি পংকজের অনুসারীরা দেখভাল করতেন।

পংকজ নাথের ইলিশ সিন্ডিকেটে ছিলেন হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ, বড়জালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন হাওলাদার এবং হিজলা-গৌরনদী ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মিলন। তাঁদের মধ্যে সুলতান মাহমুদের সঙ্গে পংকজ নাথের সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় বছর চারেক আগেই তিনি ছিটকে পড়েন। ৫ আগস্টের পর থেকে তাঁরা ঘাটের কাছে ঘেঁষছেন না। ফলে বিএনপি নেতারা মাছঘাট দখলে নিয়েছেন।

মেঘনাতীরের অন্তত তিনটি মাছঘাটের সরকারের (ম্যানেজার) সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, ৫ আগস্টের আগে অন্তত ৪৭টি মাছঘাট ছিল। জানপুর, নাছোকাঠি ও বালুরচরে প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হতো। এ ছাড়া অপর ছোট ঘাটে গড়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মাছ বিকিকিনি হতো। সে হিসাবে নিষেধাজ্ঞার ২২ দিনে গড়ে প্রতিদিন তিন কোটি টাকার ইলিশ বিকিকিনি হতো। সিন্ডিকেটই সেই মাছ কিনে নিতো। নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে মাছের দাম এক-চতুর্থাংশে নেমে যেত।

বিশেষ দাদন, প্রশাসন ম্যানেজ আর ঘাটের কমিশন মিলিয়ে বিক্রির ৬০ শতাংশ টাকা সিন্ডিকেট পেত। ফলে সিন্ডিকেটের হাতেই এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা চলে যেত। ২২ দিনে সেই টাকার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াত প্রায় ৪০ কোটিতে। তবে জাটকা রোধ অভিযানের সময় মাছঘাট থেকে গড়ে দুই কোটি টাকার ইলিশ বিকিকিনি হতো। তখন অর্ধেক পেত সিন্ডিকেট, বাকিটা জেলেরা নিতেন। সে হিসাবে জাটকা অভিযানের ছয় মাসে ৫০ কোটি টাকা সিন্ডিকেট পেত।

মাছঘাটে প্রতিদিন দাম বেঁধে দিত সিন্ডিকেট। এখান থেকে নিষেধাজ্ঞার সময় ৯০ কোটি টাকা পেত সিন্ডিকেট। আর ক্রেতা-বিক্রেতার মাধ্যমে বছরের সাত মাসেই ১৮০ কোটি টাকা পেত ইলিশ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া ইলিশ মৌসুমে দাদন আর কমিশনের মাধ্যমে অন্তত ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা আয় করত সিন্ডিকেট। পুরো টাকার একটি বড় অংশ নিতেন পংকজ নাথ।

মেঘনাতীরের আবুপুরের জেলে শফিক গাজী, মিলন হাওলাদার, সমুজ মৃধা বলেন, নিরাপদ স্থানে দিনে, আর অনিরাপদ কিছু এলাকায় রাতে হাট বসে। এসব ঘাট থেকে ইলিশ মজুদের পাশাপাশি জাহাজযোগে চট্টগ্রামে পাচার হতো। তাঁরা বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময় সবচেয়ে বড় মাছঘাট হিজলার জানপুরেই প্রতি রাতে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকার ইলিশ অবৈধভাবে বিক্রি হতো।

এক চরেই আয় আড়াই কোটি টাকা : মেঘনার বালু, মাছঘাট ও চরের নিয়ন্ত্রণ খাত থেকে দখলদারদের বছরে আয় কোটি কোটি টাকা। দখলদাররা চরে গরু-মহিষ চরানো বাবত বছরে কোটি টাকা আয় করেন। পাশাপাশি অবৈধভাবে মেঘনা থেকে বালু উত্তোলন করেও কোটি কোটি টাকা আয় করেন। বছরে বালুমহাল আর ইলিশঘাট থেকে আড়াই শ কোটি টাকার বেশি আয় হয়।

মেহেন্দিগঞ্জের গোবিন্দপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন তালুকদার বলেন, মেঘনার বুকে প্রায় ১৫ হাজার একর চরাঞ্চল রয়েছে। এই চর ঘিরে বছরে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা অবৈধ আয় হয়। সাবেক এমপি পংকজ নাথ এবং তাঁর অনুসারী গোবিন্দপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত আলতাফ হোসেন সরদার ও তাঁর ছেলে তারেক সরদার, সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন তালুকদারের নিয়ন্ত্রণে চরটি ছিল।

অবৈধ বালু উত্তোলন : মেঘনার হিজলা অংশের ধুলখোল এবং হিজলা-গৌরবদী ইউনিয়নে লালচে বালু ঢাকার আশপাশের এলাকায় বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। এই বালু উত্তোলন করে একটি গ্রুপ নৌপথে ঢাকায় নিয়ে ব্যবসা করতেন। প্রতিটি ড্রেজারে কম করে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকা করে নিতেন পঙ্কজ অনুসারীরা।

১১ জনকে হত্যার অভিযোগ পংকজের বিরুদ্ধে : বরিশাল জেলা পরিষদের প্রশাসক মইদুল ইসলাম ২০১৭ সালের ২৩ মে জেলা পরিষদ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি সেই সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগে নিজের মালিকানাধীন বিহঙ্গ পরিবহনে তাঁর (পংকজ নাথ) মদদে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করা হয়। বিহঙ্গ পরিবহনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ১১ জনকে। প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি আদায় করে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য পংকজের নির্দেশেই ১১ জনকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

কুমিল্লা-১০ আসনে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০১৪ সালে চৌদ্দগ্রামে আশিকুর রহমান বাপ্পী নামের স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বরিশালের সাবেক এমপি পংকজ নাথের কাছ থেকে সংগ্রহ করে গানপাউডার দিয়ে একটি বাস পুড়িয়ে দেন। এতে আট যাত্রী প্রাণ হারায়।

যত সম্পত্তির মালিক পংকজ দম্পতি : মেহেন্দীগঞ্জ আর হিজলা উপজেলা নিয়ে বরিশাল-৪ সংসদীয় আসন। মেঘনাতীরের এই দুটি উপজেলাই বিভাগীয় শহর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। আয়তনের বড় একটা অংশই চরাঞ্চল। সে কারণে এই সংসদীয় আসনে পংকজ নাথের নামে জমাজমি নেই। তবে গোটা চরাঞ্চলই ছিল তাঁর অনুসারীদের দখলে। মেহেন্দীগঞ্জে তাঁর একটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। ধানমণ্ডিতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, উত্তরায় ১০ তলা বাড়ি, মালিবাগে গার্মেন্টস, পরিবহন ব্যবসাও রয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন পংকজ নাথ। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। গত দুইবারের সংসদ সদস্য পংকজের আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে চার গুণ। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। তবে দেশের বাইরে অর্থপাচারের বিষয়টি নাম প্রকাশে অনুচ্ছক অনেক নেতাকর্মী বলেছেন। তবে তাঁরা তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেননি। সূত্র: কালের কন্ঠ

এআরএস

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- SHUMANBD.COM