ডেস্ক রিপোর্ট: এ এক অন্যরকম গল্প। যে গল্প হার মানায় রূপকথাকেও। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মারপ্যাঁচে যেখানে বন্ধু হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতক। বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজে হয়ে গেলেন এক রাজ্যের মহারাজা। অন্যদিকে যার জন্য তিনি পেলেন রাজ্য, তাকে ছুড়ে দেয়া হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এমন কাহিনী গল্প আর সিনেমাতেই দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে এমন এক গল্পের খলনায়ক ওবায়দুল করিম চৌধুরী। আর তার রাজ্যের নাম ওরিয়ন। ওরিয়ন গ্রুপ।
ঢাকার প্রবেশ পথ যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান যে ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে এই ওরিয়ন গ্রুপের তত্ত্বাবধানেই। এখানেও রয়েছে আরও ভয়ঙ্কর গল্প। তার আগে রাজ্য দখলের গল্প আপাতত কিছুটা জেনে আসা যাক। দুই দশক আগের কথা। তখন ২০০৩ সাল। এ সময় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে আসেন সেদেশের ধনকুবের ব্যবসায়ী মাজেদ আহমেদ সাইফ বেলহাসা। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে নির্র্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করা। বাংলাদেশে এসে ঘটনাচক্রে যোগাযোগ হয় ওবায়দুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে। বেলহাসা জানান, তার মনের ইচ্ছার কথা। লুফে নেন ওবায়দুল করিম চৌধুরী। দুইজনের মধ্যে কথা হয়। হয় বন্ধুত্ব। একে- অপরকে বিশ্বাস করেন। তাহলে আর দেরি কেন?
২০০৩ সালেই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন ধনকুবের বেলহাসা। দুবাইভিত্তিক কোম্পানি বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকটিং কোম্পানি এলএলসি ও বেলহাসা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি এলএলসি’র শাখা খোলেন বাংলাদেশে। সঙ্গে নেন বন্ধু ওবায়দুল করিম চৌধুরীকে। বেলহাসা ঢাকার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজে অর্থ বিনিয়োগ করেন। এক বছরের মাথায় কূটচাল চালতে থাকেন ওবায়দুল করিম। ফন্দি আঁটেন পুরো ব্যবসা নিজের করে নেয়ার। ওদিকে ওবায়দুল করিম বেলহাসার প্রকল্পের নামে ব্যাংক লোন নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার শুরু করেন। বিষয়টি জেনে যায় বেলহাসা। এছাড়া বেলহাসা কোম্পানির শেয়ার ভাগাভাগী নিয়েও দু’জনের মধ্যে সৃষ্টি হয় দূরত্ব।
এ সময়ে ওবায়দুল করিম শুরু করেন কোম্পানি হাতিয়ে নেয়ার চক্রান্ত। খুবই দ্রুত জাল-জালিয়াতি করে পুরো কোম্পানি দখলের চেষ্টা করেন। এ কাজে সহায়তা নেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরও। জাল স্বাক্ষর করে কোম্পানির নামও বদলে দেন। বেলহাসা থেকে নাম পাল্টে হয়ে যায় ওরিয়ন গ্রুপ। এ গ্রুপের চেয়ারম্যান হন ওবায়দুল করিম। এরপর শুরু হয় তার অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, শেয়ার প্রতারণা, অংশীদারদের শেয়ার দখল। শুধু তাই নয়, পরিবারের সদস্যদের নামে ভুয়া মালিকানা হস্তান্তর শুরু করেন। এরপর জড়ান একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। এ থেকেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ওরিয়ন গ্রুপের নাম। ওবায়দুল করিম চৌধুরীর নাম।
একজন বিদেশি ধনকুবের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে নিঃস্ব হয়ে ফিরেন তার দেশে। সঙ্গে বয়ে নিয়ে যান নজিরবিহীন এক প্রতারণার ইতিহাস। ওবায়দুল করিমের নেশাই ছিল এটি। শুধু বেলহাসা নয়, একম ইঞ্জিনিয়ারিং নামে আরেকটি কোম্পানি এভাবে দখল করেন ওবায়দুল করিম। তার সেই অংশীদারকেও করেন দেশছাড়া। ওবায়দুল করিমের উত্থানের শুরু এমন নাটকীয়ভাবে। শুরুতেই দুবাইভিত্তিক কোম্পানি বেলহাসার শেয়ার কেলেঙ্কারি করে হাতিয়ে নেন কোম্পানির দেড় হাজার কোটি টাকা। ওদিকে ক্ষমতা খাটিয়ে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা লোপাট করে রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এদিকে ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধার ওবায়দুল করিমের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার স্ত্রী সন্তানসহ ৬ জন ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যবসা এবং পৃথক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট জব্দ করতে বলেছে। রাতে বিএফআইইউর সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য মিরর এশিয়াকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
হিসাব জব্দ করাদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সব লেনদেন বন্ধ থাকবে। আগামী ৩০ দিন এসব হিসাবে কোনো ধরনের লেনদেন করতে পরবে না। প্রয়োজনে লেনদেন স্থগিত করার এ সময় বাড়ানো হবে। লেনদেন স্থগিত করার এ নির্দেশের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা সংশ্লিষ্ট ধারা প্রযোজ্য হবে বলে বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়েছে। চিঠিতে ওবায়দুল করিম ও তার স্ত্রী আরজুদা করিম ছেলে সালমান ওবায়দুল করিম, মেহেদি হাসান ও মেয়ে জারিন করিম এর নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেজাউল করিমের নামসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যও দেওয়া আছে।
বিএফআইইউর নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, কোনো হিসাব স্থগিত করা হলে হিসাবসংশ্লিষ্ট তথ্য বা দলিল যেমন হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি ও লেনদেন বিবরণী ইত্যাদি চিঠি দেওয়ার তারিখ থেকে ২ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের কাছে পাঠানোর জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয়েছে।