নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা সিটি করপোরেশন যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রকল্প ব্যয় ধরে ৬৭০ কোটি টাকা। সেই অনুযায়ী ওবায়দুল করিম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১০ শতাংশ সুদে ৬০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। এরমধ্যে জনতা ব্যাংক-২০০ কোটি, এসআইবিএল ব্যাংক-৫০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক-১৫০ কোটি, আইসিবি ব্যাংক-৫০ কোটি, রূপালী ব্যাংক-১৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়। তবে ওবায়দুল করিম তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক আসিকুর রহমান ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের যোগসাজশে তথাকথিত আরবিট্রেশনের নামে চুক্তির ৬৭০ কোটি টাকা থেকে ব্যয় বাড়িয়ে ২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করেন।
তবে আরবিট্রেশন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সিমপ্লেক্স ইনফ্রাক্টাকচার লি. ইন্ডিয়ার সঙ্গে হওয়া চুক্তিমতে, ফ্লাইওভারে কনস্ট্রাকশন কাজে মোট খরচ হয় ৭৮৮ কোটি টাকা। অথচ প্রকল্প ব্যয় ধরা ছিল ৬৭০ কোটি টাকা। কিন্তু অবৈধভাবে ব্যয় বর্ধিত করা হয় ২৩৭৮ কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বন্ড ডিসকাউন্টের মাধ্যমে বন্ধক রেখে ২১৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এরমধ্যে ১৩৬২ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয় এমন তথ্যও প্রকাশ পায়।
এদিকে বেলহাসা ও একম ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যাংক একাউন্টে লেনদেনের স্টেটমেন্ট ঘেঁটে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার প্রকল্পে ৭৯০ কোটি টাকা খরচের তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি ১৩৬০ কোটি টাকার কোনো হদিস মেলেনি। ২০১১ সালের ২৮শে নভেম্বর বেলহাসা-একম জেভি অ্যান্ড এসোসিয়েটের নাম পরিবর্তন করে অবৈধভাবে ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার নামকরণ করা হয়। এই নাম পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় ওবায়দুল করিম বেলহাসার প্রধান অংশীদার মাজেদ বেলহাসা ও পার্টনার মুজিবুল হকের স্বাক্ষর জাল করেন। এজিএম ছাড়াই তাদের কোম্পানি থেকে বের করে দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওবায়দুল করিম যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার থেকে আদায়কৃত টোলের মাত্র ৪০ শতাংশ হিসাবে দেখান। বাকি ৬০ শতাংশ টোলের টাকা গোপনে সরিয়ে নিচ্ছেন। ১২ বছর ধরেই চলছে এ ঘটনা। এমন বেশকিছু টোল আদায়ের ব্যালেন্স সিট পাওয়া গেছে। ফ্লাইওভার সরজমিন ঘুরেও এমন চিত্র দেখা গেছে। নির্দিষ্ট টোল প্লাজা বাদ দিয়েই ফ্লাইওভারের বিভিন্ন পয়েন্টে চালকদের হাতে রশিদ ধরিয়ে টোল আদায় করছেন ওরিয়নের পোশাক পরিহিত কিছু ব্যক্তি। এভাবে টাকা নেয়ার হিসাব থাকছে না কম্পিউটারের সফ্টওয়্যারে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসাব বলছে, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলে ৮ থেকে ১০ হাজার। সে হিসাবে টোল আদায় হওয়ার কথা বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর ওরিয়ন হিসাব দিচ্ছে বছরে ১৪০ কোটি থেকে ১৭৮ কোটি টাকার। এ ছাড়া ফ্লাইওভার নির্মাণ নকশা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নিচের রাস্তা বন্ধ করে পায়ার ও ডিভাইডার করা হয়েছে যাতে গাড়ি কম চলতে পারে।
জালিয়াতি করে একম এবং বিদেশি জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি বেলহাসার প্রধান অংশীদারকে বাদ দিয়ে ওরিয়নের মালিক বনে যান ওবায়দুল করিম। ২০০৩ সালের মে মাসে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার প্রকল্পটি দুই স্তর বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে যোগদান করা দাতাদের কারিগরি অভিজ্ঞতা ও আর্থিক যোগ্যতা চাওয়া হয়। সে সময় আন্তর্জাতিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে দরপত্রে অংশ নেয় ওবায়দুল করিম। আইনগত শর্ত পূরণের জন্য ওরিয়ন গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান একম অ্যান্ড এসোসিয়েটস লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় কোম্পানি গঠন করে বেলহাসা।
যৌথ মালিকানার কোম্পানির নাম দেয়া হয় বেলহাসা একম অ্যান্ড এসোসিয়েটস লিমিটেড। পরে আর্থিক বিবেচনায় বেলহাসা একম কনসোর্টিয়াম প্রকল্পটির কাজ পান। সেই প্রেক্ষিতে ২০০৫ সালের ৯ই আগস্ট বেলহাসা বরাবর লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) ইস্যু করেন সিটি করপোরেশন। এমনকি নিয়ম অনুযায়ী কনসোর্টিয়াম অংশীদারদের সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কোম্পানি বেলহাসা একম অ্যান্ড এসোসিয়েটস লিমিটেড (এসপিভিসি) নামে কোম্পানি নিবন্ধিত হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে যাত্রাবাড়ী- গুলিস্তান প্রকল্পটি বেলহাসা একম অ্যান্ড এসোসিয়েটস সরকারের অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করে। দরপত্র দাখিল করে বেলহাসা দুবাই ও একম বাংলাদেশ নামে।
টেন্ডার প্রক্রিয়ায় চুক্তি অনুযায়ী বেলহাসা ৬০ শতাংশ ও একম ৪০ শতাংশ বিডার ছিলেন। কিন্তু দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুবাইভিত্তিক কোম্পানি বেলহাসা প্রধান বিডার হিসাবে অংশ নিলেও ওবায়দুল করিম একম ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে নিজে ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে শেয়ার হোল্ডার করে দেন। অথচ কাগজপত্র বলছে, শুরুতে দুবাইয়ের নাগরিক শেখ মাজেদ আহমেদ সাইফ বেলহাসা কোম্পানির ৮০ শতাংশ ও ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যরা মাত্র ২০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ২০০৫ সালের ২০শে মার্চ দুবাই নাগরিক শেখ মাজেদ আহমেদ সাইফ বেলহাসার স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানিটির রেজিস্ট্রশন নিজের নামে করে নেন ওবায়দুল করিম। অথচ দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদনে কোথাও ওবায়দুল করিম, ছেলে সালমান করিম ও মেয়ের জামাই মেহেদী হাসানের নাম ছিল না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে বেলহাসাকে বের করে দিয়ে সম্পূর্ণ কোম্পানি দখল করে নেয় ওবায়দুল করিম পরিবার। ভুয়া চুক্তিপত্রের মাধ্যমে বেলহাসার ৮০ শতাংশ শেয়ার থেকে মাত্র ৫ শতাংশ শেয়ার রেখে বাকি শেয়ার নিজের একম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নামে লিখে নেন। পরে বেলহাসা পরিবার দাবি করেন করিম পরিবারের সঙ্গে তাদের কোনো চুক্তি হয়নি। যে কাগজপত্র দেখানো হয়েছে তা ভুয়া।
অবৈধভাবে বোর্ড মিটিং দেখিয়ে ওবায়দুল করিমের ছেলে সালমান করিম ও জামাই মেহেদী হাসানের নামে কোম্পানির সব শেয়ার স্থানান্তর করা হয়। একইভাবে দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান বেলহাসার শেয়ারও জাল-জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেয়া হয় ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে। এমনকি যৌথ বিনিয়োগকারী কোম্পানির নাম পাল্টে নতুন নাম দেয়া হয় ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। পরে যৌথ কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কর্তৃত্ব নিয়ে নেন ওবায়দুল করিম।
এই সময়ের মধ্যে বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ৬০০ কোটি টাকা পর্যায়ক্রমে ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়। তখন বিদেশি কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন ওবায়দুল করিম। এই জাল- জালিয়াতি ও অবৈধভাবে কোম্পানি দখলের সমস্ত কাগজপত্র মানবজমিন-এর হাতে সংরক্ষিত আছে। পরবর্তীতে বিদেশি কোম্পানি বেলহাসা ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতি করে কোম্পানি দখলের অভিযোগে আদালতে মামলা করেন। মামলা নং ৪৯৬/১০। তবে ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং ওবায়দুল করিম কৌশলে বেলহাসাকে ঠেকাতে তাদের নামে ২০১০ সালের ১৬ই আগস্ট একটি মামলা করেন। মামলা নং ৩৪৯/১০। ওই মামলায় বলা হয় বেলহাসা এই প্রকল্প কোম্পানির বেলহাসা-একম জেভি (পরিবর্তিত নাম) এর কেউ না। এমনকি বেলহাসা যাতে প্রতিকার চেয়ে সরকারের কাছে কোনো চিঠিপত্র দিতে না পারে এজন্য আদালত থেকে একটি নিষেধাজ্ঞা নেয়া হয়। উপায়ন্ত না পেয়ে বেলহাসার মালিক মাজেদ আহমেদ বেলহাসা জুবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া নামের এক আইনজীবীকে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়েন।