নিজস্ব প্রতিবেদক: ৩৬ বছরের মধ্যে কঠিন সময় পাড় করছে দেশের তৈরি পোষাক শিল্প। বর্তমানে দেশের ৪০ ভাগ তৈরি পোষাক শিল্প লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। গত দুই বছরে এই খাতের মোট ২৫০টিরও বেশি কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন এ শিল্পের মালিকরা। বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এই সেক্টরে আমার ৩৬ বছরে বিভিন্ন কঠিন সময় পার করেছি। তবে বর্তমানের মত এত কঠিন পরিস্থিতি আর দেখিনি।’
পোশাক শিল্পের বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে উভয় সংগঠনের সদস্য প্রায় ২৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ে কিছু কারখানা নতুন করে উৎপাদনে আসলেও – তা বন্ধ হওয়া কারখানার তুলনায় একেবারেই কম বলে জানিয়েছেন দুই সংগঠনের নেতারা।
শুধুমাত্র গত দুই সপ্তাহে, ক্রনি গ্রুপ এবং বার্ডস গ্রুপের মতো প্রধান গ্রুপগুলো তাদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে, যা পরিস্থিতির তীব্রতাকেই তুলে ধরছে। একইভাবে, ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত অ্যাডামস অ্যাপারেলস লিমিটেড এবং অ্যাডামস স্টাইলসের মালিকপক্ষ অর্ডার কমতে থাকায়, ব্যাংকের দায়দেনা বাড়তে থাকায় চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল হক মুকুল বলেন, ‘কোভিড-১৯ থেকেই সমস্যার শুরু। এর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ… অর্ডার কমতে থাকে। ব্যাংকের সাপোর্ট পাচ্ছিলাম না। কাস্টমসের হয়রানি ছিল – এসবের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে এক পর্যায়ে বেতন বকেয়া হয়ে যায়। পরে বাধ্য হয়ে উৎপাদন ছোট করে আনতে হয়।’
কেবল ছোট পুঁজির কারখানা নয়, অপেক্ষাকৃত বড় কারখানাও বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে এমনকি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইউটিলিটি সংকট ও অর্ডার কমতে থাকায় অনেকেই লোকসান দিতে শুরু করেছে। রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লাহ অ্যাপারেলস লিমিটেড ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লোকসান গুনেছে ৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা। কারণ উৎপাদনের খরচ বাড়লেও – বায়াররা যে দামের প্রস্তাব দিচ্ছে, তাতে মুনাফা দুরে থাক, খরচও পোষাচ্ছে না। এতে একের পর এক অর্ডার মিস করতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। যার কারণে লোকসান গুনতে হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘এই সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকা ডিভ্যালুয়েশন (অবমূল্যায়ন) হওয়ার ফলে প্রাপ্ত গেইন এবং সরকারের ইনসেনটিভ (প্রণোদনা) ক্যালকুলেশন করার পরও লোকসানের এই অঙ্ক দাঁড়িয়েছে।’
একই মালিকের ফতুল্লাহ ডায়িং লিমিটেড নামে আরেকটি কারখানা আলোচ্য সময়ে লোকসান করেছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এর কারণ হিসেবে এহসান জানিয়েছেন, গ্যাসের (ডায়িংয়ে প্রচুর গ্যাসের প্রয়োজন হয়) দর বেড়েছে, কিন্তু সাপ্লাই কম ছিল। ফলে অর্ধেকের কম ক্যাপাসিটিতে কারখানা চালু রাখতে হয়েছে।
পোশাক রপ্তানির ব্যাক টু ব্যাক এলসি বা কাঁচামাল আমদানির প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যাংকাররাও সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক প্রস্তুতকারকদের মুনাফায় পতনের কথা জানিয়েছেন। রাজধানী ঢাকায় সিটি ব্যাংকের একটি প্রধান শাখার শীর্ষ এক কর্মকর্তা, যিনি পাঁচটি বড় রপ্তানিকারক গোষ্ঠীর এলসি ব্যবস্থাপনায় জড়িত তিনিও সাম্প্রতিক সময়ের শ্রম অসন্তোষের কারণে এরমধ্যে তিনটি ব্যবসাই প্রভাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। নাম না প্রকাশের শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘অর্ডারের ফ্লো কম থাকায় মুদ্রা অবমূল্যায়নের সুবিধা নিচ্ছে বায়াররা।’
তিনি আরো বলেন, ‘শ্রম অসন্তোষের কারণে একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি সমস্যার মুখে পড়ে। এরকম বেশকিছু প্রতিষ্ঠান সময়মতো রপ্তানি চালান পাঠাতে না পারায়– ব্যাংকের কাছে তাদের দায়দেনা বেড়ে গেছে। আইএফআইসি ব্যাংকের উত্তরা শাখার একজন কর্মকর্তাও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কারখানার দায় বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। যেমন একটি কারখানা সময়মতো কিস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ায়– তাঁদের বিরুদ্ধে ফোর্সড লোন জারি করতে হয়েছে। ‘অথচ এই ১০টি কারখানা দুই বছর আগেও কখনো এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েনি’ – যোগ করেন তিনি।
কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, মুদ্রার অবনমনের বেশিরভাগ সুবিধাটাই যাচ্ছে বায়ারদের পকেটে। ফলে এর সুবিধা নিয়ে বেড়ে যাওয়া উৎপাদন ব্যয় পুষিয়ে নিতে পারছেন না গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা।’ বেশকিছু কারখানার ব্যাংকের দেনা বাড়ার কথা তিনিও উল্লেখ করেছেন।
পূর্ণ সক্ষমতায় কারখানা চালু রাখতে না পারায় পোশাক উৎপাদকদের মুনাফাযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে বলে মনে করছেন মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তার মতে, এই পরিস্থিতিতে যাদের ব্যাংক ঋণ বেশি তারা অনেকখানি ঝুঁকির মধ্যে আছে।
দেশের শীর্ষ একজন পোশাক রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সাধারণত পোশাক কারখানায় বিনিয়োগের রিটার্ন হিসাব করা হয় তিন থেকে চার বছর ধরে নিয়ে, আর নিট প্রফিট মার্জিন ধরা হয় ৬ থেকে ৯ শতাংশ। এক সময় আমরাও এই হারে প্রফিট (মুনাফা) করতেও পারতাম। কিন্তু, বর্তমানে কেউই এই হারে প্রফিট করতে পারছে বলে মনে হয় না।’
‘আমার প্রফিট নেমে এসেছে ২.৫ শতাংশে’ –বলেন ১৫ হাজার শ্রমিকের ওই কারখানার মালিক। অবশ্য মাত্র ৪৫০ জন শ্রমিকের একটি কারখানা, যারা উচ্চ মানের পণ্য তৈরি করে – এমন একটি কারখানার উদ্যোক্তা জানালেন, তার মুনাফাযোগ্যতা একই রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি কিছু ব্যতিক্রমী পোশাক তৈরি করি অপেক্ষাকৃত উচ্চ মূল্যের। আমার ক্রেতা্রাও বাড়তি কস্ট অব প্রোডাকশন (উৎপাদন খরচ) হিসাব করেই দর দিচ্ছেন।’
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, গত দুই বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫০ শতাংশ, আবার একই সময়ে দর না বেড়ে কোন কোন ক্ষেত্রে কমেছে। কিছু কারখানা এই লোকসান পোষাচ্ছে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও সরকারের কাছ থেকে পাওয়া প্রণোদনার টাকায়। তবে গত জুলাই থেকে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
গত এক মাস থেকে গাজীপুর, সাভারের কারখানাগুলো শ্রম অসন্তোষের জেরে বেশিরভাগ সময় উৎপাদন করতে পারেনি। এর সঙ্গে টিফিন বিলসহ কিছু এল্যাউন্স যুক্ত হয়েছে। নতুন করে আলোচনা হচ্ছে মজুরি বৃদ্ধির।
উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই জানিয়েছেন, ব্যাংকে তাদের দায় বাড়ছে। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি নাহলে— আগামী মাসগুলোতে একদিকে শ্রমিকের বেতনের চাপ বাড়বে, অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে পারে। ফলে দ্বিমুখী চাপ তৈরি হয়ে খেলাপির সংখ্যা বাড়তে পারে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এতদিন নিয়ম ছিল কেউ ৬টি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে খেলাপি হতো। সেপ্টেম্বর থেকে ৩ কিস্তি শোধে ব্যর্থ হলে খেলাপি হিসেবে গণ্য হবেন।’ ‘সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে’ –জানিয়ে তিনি বলেন , ‘ আমিও হয়তো খেলাপিতে পরিণত হতে পারি।’
টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তাদের পরিস্থিতিও একই রকম। বিশেষত গ্যাস সংকটের কারণে এই খাত বিপাকে পড়েছে বেশি। আবার কেউ কেউ লোকাল ব্যাক টু ব্যাক এলসি’র বিপরীতে ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছেন না।