শনিবার | ৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাষ্ট্র সংস্কারের মতো বাংলাদেশ স্কাউটসেও আমুল সংস্কার দরকার

বিশেষ প্রতিবেদক: বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশ স্কাউটস হয়ো উঠেছে দুর্নীতিবাজদের আখড়া। সাবেক মুখ্য সচিব ও পরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ প্রধান জাতীয় কমিশনার নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই স্কাউট সংগঠনটিকে প্রথমে পারিবারিক ও পরে নিজের পছন্দের লোকদের নিয়ে সাজাতে থাকেন। শুরু হয় স্কাউটি-এর স্বেচ্ছাসেবী চরিত্র বদলে সরকারী ও দলীয় করণের কাজ। নিজের এক ভাইকে জাতীয় কমিশনার ও অন্য ভাইকে মেট্রোপলিটান স্কাউটসের কমিশনার বানিয়ে তার কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশ স্কাউটস বিশ্ব স্কাউট সংস্থার সদস্য। সে মতে সংগঠনটি কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা নয়। স্কাউটের গঠনতন্ত্রে সে কথা বলা থাকলেও আবুল কালাম আজাদ এই সংগঠনটিকে সরকারী করণ করেন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অধিদপ্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনের ওয়েব সাইটটিও সরকারি ডোমেইনের আওতায় নিয়ে আসেন। সর্বশেষ তিনি যখন সংসদ সদস্য হয়ে একটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি হন, তখন তারা পিএস হিসেব যাকে নিয়োগ করেন, তিনিও বাংলাদেশ স্কাউটসের একজন সহকারী পরিচালক। তার নিয়োগ পত্রেও স্কাউট সংগঠনটিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অধিদপ্তর হিসেবে দেখানো হয়, আইনের সুস্পষ্ট ব্যাত্যয়। অথচ তিনি নিজেই আইন প্রণেতা।
তিনি দুই মেয়াদে বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রধান জাতীয় কমিশনার থাকার পর সভাপতি নির্বাচিত হন।প্রধান জাতীয় কমিশনার হন সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব ও পরে দুদকের কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান প্রধান জাতীয় কমিশনার হিসেবে টানা ১০ বছন দায়িত্ব পালন করেন। নিয়মানুসারে ৯ বছরের বেশী একই পদে থাকার কথা নয়। তিনি নিজ মেয়াদ বাড়য়ে নেন তার মনোনীত জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে।
মো. মোজাম্মেল হক খানের সময়েই সবচেয় বেশী দুর্নীতি হয় স্কাউটসে। তার মনোনীত জাতীয় কমিশনারগণ এবং তার পছন্দের সার্বক্ষণিক স্কাউট কর্মকর্তাগণ মিলে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতিতে মেতে ওঠেন। বিশেষ করে এ তালিকায় রয়েছে মাহমুদুল হক বাবলু, নাজমুল হক নাজু, এএইচএম মোহসীনুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম প্রমুখ। তাদের দুর্নীতি নিয়ে ইতোপূর্বে জাতীয় গণমাধ্যমে অনেকবার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। খোদ মোজাম্মেল হক খানের বিরুদ্ধেও রয়েছ সরকারী অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ। তিনি দুদকের কমিশনার হিসেবে সর্বত্র প্রভাব খাটিয়েছেন বলে জানা যায়। তার ছত্রছায়াতেই স্কাউট কর্মকর্তাগণ ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন এবং মোজাম্মেল হক খানের প্রভাব থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেয়া যায়নি।তারপরও নাজমুল হক নাজুর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীন তদন্তে সুনির্দষ্ট দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা, স্কাউটসের তৎকালীন সহ-সভাপতি প্রফেসর নাজমা শামস। তবে প্রধান জাতীয় কমিশনার মোজাম্মেল হক খান নাজমুল হক নাজু বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্তা না নিয়ে তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। এবিষয়ে প্রফেসর নাজমা শামস বলেছেন, “কাজী নাজমুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। নাজমুল হকের বিরুদ্ধে এ টু জেড দুনীর্তির প্রমাণ রয়েছে। আমাকে তদন্ত করার জন্য ২০ দিন সময় দেয়া হয়, ৭ দিনে তদন্ত শেষ করেছি। প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর অনেগুলো ২০ দিন পার হলেও ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাংলাদেশ স্কাউটসের চিফ ন্যাশনাল কমিশনার (মোজাম্মেল হক খান) কে একাধিকবার বলেছি, ফোন করেছি-দুইতিন মাস হয়ে গেল কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। উনি আমাকে বললেন, আমি দেখতেছি, দেখব।… … আমি নিজেই ভাবতেছি একটা মামলা করে দেবো, আমাকে বেকার পরিশ্রম করানোর জন্য।“
নাজমুল হক নাজুর বিরুদ্ধে ভারত, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া ও কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত জাম্বুরীতে স্কাউট মনোনয়ন, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বিমান ভাড়া নগদে আদায় এবং জনপ্রতি (৭০০ জন স্কাউট) ৫ কেজি চাল বাধ্যতামূলকভাবে বহন করা এবং তা কোরিয়ায় উচ্চমূল্যে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। এ কাজে তার সহায়ক ছিলো স্কাউট সদর দপ্তের দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত মোহসীনুল ইসলাম, সাইফুল ইলমা ও ইকবাল। উল্লেখ্য নাজমুল হক নাজুর এ সকল কাজের নেতৃত্ব প্রদান করেছেন আরেকজন আন্তর্জাতিক কমিশনার মাহমুদুল হক বাবলু।
সারা দেশে সরকারি টাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েও রয়েছ নানান অভিযোগ। বাংলাদেশ স্কাউটসের পরিচালকদের একই সাথে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ নিয়েও হয়েছে নানা দুর্নীতি। ঘুরে ফিরে পরিচিত কয়েকটা মুখই গত ১৬ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এখানে মোজাম্মেল হক খানের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদ রয়েছে। শেষের দিকে জাতীয় কমিশনার (উন্নয়ন) আখতারুজ্জামান খান কবীরের নামও এ অপকর্মের সাথে যুক্ত বলে জানা যায়।
২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ছিলো মোজাম্মেল হক খানের কার্য-মেয়াদের শেষ দিন। তিনি ৬ মাসের জন্য মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়ে ২ জুন ২০২৪ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। এখানে দুটো প্যানেল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। মোজাম্মেল হখ খান তার বর্ধিত মেয়াদে জাতীয় কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করেন সাবেক কেবিনেট সবিচ ও আওয়ামী লীগের সদস্য কবির বিন আনোয়ারকে এবং তাকেই নিজ প্যানেল থেকে প্রধান জাতীয় কমিশনার হিসেবে মনোনয়ন দেন; নিজে সভাপতির পদে নির্বাচন করেন। অন্য প্যানেলটি বিদায় সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, এমপি সমর্থিত যেখানে প্রধান জাতীয় কমিশনার পদে নির্বাচন করেন সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ মো. কামাল। সভাপতি প্রার্থী হন প্রফেসর নাজমা শামস। নির্ধারিত ২ জুন জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ওসমানী মিলনায়তনে। নির্বাচন পর্ব শুরু হলে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান আখতারুজ্জামান নির্বাচনে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করেন। ৩৬/৩৮ জন কাউন্সিলর ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। তখনি বিদায় সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, এমপি কাউন্সিল মুলতবী ও ভোটগ্রহন স্থগিত করেন। যা ছিলো সম্পূর্ণ বে-আইনি। বিশেষ পরিস্থিতিতে কেবল নির্বাচন কমিশনারই নির্বাচন স্থগিত করতে পারেন, যা হয়নি। এখানে মোজাম্মেল হক খানের নেপথ্য ভূমিকা ছিলো স্পস্ট।মুলতবী সভা ২৪ ঘন্টার মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেই সভা অনুষ্ঠিত হয় ১ মাস ৪ দিন পরে ৬ জুলাই। এ প্রক্রিয়াও বেআইনী ভাবে নেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিলো মোজাম্মেল হক খানের প্যানেলকে জিতিয়ে আনা। তাদের সে চেষ্টা ব্যার্থ হলেও ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মোজাম্মেল হক খান সভাপতি নির্বিচত হন, তবে বাকী পদগুলোতে (সহ-সভাপতি, প্রধান জাতীয় কমিশনার ও কোষাধ্যক্ষ) আবুল কালাম আজাদের মনোনীত প্যানেল থেকে মনোনীতরা নির্বাচিত হন।
ইতোমধ্যে কোটাবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে দেশে সরকারের বিদায় নেয়া ও রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আন্দোলনের শহীদ হয় ৭ জন রোভার স্কাউট।
নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে স্কাউটেসর নব নির্বাচিত প্রধান জাতীয় কমিশনার ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। মোজাম্মেল হক খানের নেতৃত্বে এখন চেষ্টা চলছে পুনরায় স্কাউট অঙ্গন দখল করার। এরি মধ্যে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন বিপুল বিজয়ের ধারাবাহিকতায় রোভার স্কাউটাও দুর্নীতিমুক্ত স্কাউট চাই বলে আন্দোলনে নেমেছে। এমতাবস্থায় দীর্ঘ ১৬ বছর আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী নেতৃত্বকে বাদ দেয়ার দাবী প্রকট হয়ে উঠেছে। মাঠপর্যায়ের স্কাউট নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ রোভার স্কাউটদের দাবী বিগত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ও ব্যাপক দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্তদের বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশর চীফ স্কাউটই পারেন বিগত ২ জুন ও ৬ জুলাইয়ে তথাকথিত নির্বাচন বাতিল করে একটি “অন্তবর্তীকালীন প্রশাসনিক পরিষদ” নিয়োগ করে স্কউট সংগঠনকে বাঁচাতে। বাংলাদেশ স্কাউটসের গঠনতন্ত্রের ২৬ (৯) (গ) ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি তা করতে পারেন। এজন্য রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৮(৩) নম্বর অনুচ্ছেদর মতে প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।
বাংলাদেশ স্কাউটসের উপদেষ্টা পরিষদের সর্বজন গ্রহনযোগ্য ও দলনিরপেক্ষ সদস্য হলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও রাষ্ট্রদূত জনাব মোহাম্মদ আবু হেনা এবং সাবেক সচিব মুহঃ ফজলুর রহমান। আমাদের দাবী এই দুজনের নেতৃত্বে গঠিত হোক বাংলাদেশ স্কাউটসের “অন্তবর্তীকালীন প্রশাসনিক পরিষদ”, যারা স্কাউট সংগঠণের নিম্নর্পায় থেকে জাতীয় পর্যায়-সর্বত্র সংস্কার কার্য পরিচালনা করবেন।

 

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- Payra Team