সোমবার | ২৩ জুন, ২০২৫ | ৯ আষাঢ়, ১৪৩২

ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া কমাতে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বাড়ানো হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকে আমানতের সুদহার বাড়ার কারণে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহারও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগের নেতৃত্বে অংশীজনদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি এখন এ নিয়ে কাজ করছে। সে কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়াবে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগসংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সঞ্চয়পত্রে শুধু সুদহার বৃদ্ধির পরিকল্পনাতেই থেমে নেই সরকার। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং সরকারের রাজস্ব আয়ে ঘাটতি দূর করতে এখন সঞ্চয়পত্রকেই অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ জন্য সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, লক্ষ্য বাস্তবায়নে এ-সংক্রান্ত বিধিমালা ও নীতিমালায়ও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্তমানে মেয়াদ শেষে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের অর্থ সুদ-আসলে বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টে ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মেয়াদ শেষে সঞ্চয়ধারীরা তাঁদের বিনিয়োগের অর্থ তুলে না নিলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। যার থেকে সঞ্চয়ধারীরাও ওই বাড়তি বিনিয়োগের অর্থ থেকে বাড়তি সুদ-সুবিধাও পেতে থাকবেন। এ ছাড়া এখন নীতিমালার পরিবর্তনের কারণে পেনশনার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্ত সুদের টাকা প্রতি মাসেই দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা মাস শেষে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই সুদের টাকা জমা হয়ে যাবে। বাংলাদেশি মেরিনার, পাইলট ও কেবিন ক্রুরা এত দিন ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ পেতেন না, এখন তাঁদেরও এই বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এভাবে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডসহ সঞ্চয় অধিদপ্তর পরিচালিত ১১টি সঞ্চয় স্কিমের বিনিয়োগসমূহ মেয়াদ শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগের সুযোগও তৈরি হয়েছে।
যদিও দুই বছর ধরে আইএমএফের চাপ ও অধিক সুদ ব্যয়ের কারণে সরকার নিজেই জনগণের জন্য সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করাকে কঠিন করে তুলেছিল, যার প্রভাব দেখা গেছে লক্ষ্য নির্ধারণে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ কমিয়েছে। এ বছর সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া নিট ঋণের পরিমাণ আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা কম লক্ষ্য ধরেছে। গত অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর চলতি অর্থবছর এ খাত থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কিন্তু সম্প্রতি রাজস্ব আহরণ কমে যাওয়ায় এবং ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমাতে আবারও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার দিকে ঝুঁকছে সরকার। এরপরই দেখা গেছে, টানা ১১ মাস পর সঞ্চয়পত্র বিক্রির নেতিবাচক প্রবণতা কাটিয়ে আবার ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুনে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল ৩ হাজার ৩৮১ কোটি ৪৩ লাখ টাকার। এই পরিমাণ সুদ-আসল বাড়তি পরিশোধ করেও পরের মাস জুলাইতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ২ হাজার ১৮৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির প্রবণতা বাড়ছে।
চলমান ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে, তাতে ব্যাংকের আমানতের সুদহারও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে যাতে জনগণ নিরুৎসাহিত না হয়, তা ঠেকাতেই সরকারের এমন উদ্যোগ। এ ছাড়া ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের অর্থ বিনিয়োগকারীদের সুদ-আসলে ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু ডলার-সংকটের কারণে কোনো কোনো ব্যাংক এসব বন্ডে বিনিয়োগকারীদের সুদ-আসল বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। সরকার চায় দেশে অধিকতর ডলার বজায় থাকুক। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার একটা নিরাপদ সঞ্চিতি গড়ে উঠুক। জাতীয় সঞ্চয় স্কিমে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা বাড়ানোর ক্ষেত্রেও এসব বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের জন্য সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. আব্দুর রহমান খানের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে এক বৈঠক থেকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠক শেষে এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব আব্দুর রহমান খান বলেন, এত দিন ধরে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীরা তিন মাস অন্তর সুদ বা মুনাফার টাকা পেতেন। এখন থেকে প্রতি মাসে তাঁদের মুনাফার অর্থ দেওয়া হবে। ব্যাংকে আমানতের সুদহার বাড়ার কারণে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহারও বাড়ানো হবে। এ নিয়ে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
বর্তমানে চারটি সঞ্চয়পত্র, দুটি ডাকঘর সঞ্চয় হিসাব, একটি ডাক জীবনবিমা, একটি প্রাইজবন্ড ও তিনটি প্রবাসী বন্ড চালু রয়েছে। এসবে বিনিয়োগের বিপরীতে সুদ বা মুনাফার হার ভিন্ন। পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ, বছরভিত্তিক হিসাবে প্রথম বছর শেষে সাড়ে ৯ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ১০, তৃতীয় বছর শেষে সাড়ে ১০ এবং চতুর্থ বছর শেষে ১১ শতাংশ।

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- SHUMANBD.COM