শনিবার | ৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাংবাদিক নেতাদের পালানো লজ্জাজনক

দুলাল আহমদ চৌধুরী : জাতীয় প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠান। বিগত ১৫ বছর এই ক্লাবের কর্মকর্তারাও কি দখলদার ছিলেন? সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ দলবাজ সিনিয়র সাংবাদিকরাও পালিয়েছেন কিংবা গা ঢাকা দিয়েছেন! এদের আচরণ সবসময় ছিল ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকের মতো। অনেকেই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে তৈলবাজি প্রশ্নের মাধ্যমে উস্কানি দিতেন। কে কত বেশি দালালি করে প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রিয়’হবেন, সুযোগ-সুবিধা পাবেন সেই প্রতিযোগিতা চলতো। যখন যাকে ইচ্ছা, ‘সরকারবিরোধী’তকমা লাগিয়ে দিতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চরম মুহূর্তেও দলকানা সিনিয়র সাংবাদিকরা যে কোনো পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সামাজিক মাধ্যমে দেখলাম, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সহসভাপতি হাসান হাফিজ এবং যুগ্ম সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া যথাক্রমে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
২.
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন একজন প্রভাবশালী সম্পাদকের সহধর্মিনী। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় শুধু প্রেসক্লাবের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হননি, দ্বাদশ সংসদে ‘কোটা এমপি’ হয়েছেন। আর সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারত চলে যেতে চেয়েছিলেন সপরিবারে। বেরসিক ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তাকে আখাউড়া চেকপোস্ট থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ছিলেন আরো অনেক দলদাস রথি-মহারথি, যাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় গত ১৫ বছর যাবৎ চলতো প্রেসক্লাব। অবশ্য সরকারবিরোধী পক্ষের সকল সিনিয়র সাংবাদিকরাও ধোয়া তুলশি পাতা নন, ভাগ-বাটোয়ারা ও সমঝোতায় চলতো অনেক কিছু। দলবাজি না করায় অনেক পেশাদার সৎ এবং দলনিরপেক্ষ সিনিয়র সাংবাদিক প্রেসক্লাবের সদস্যপদ পাননি। কারো প্রতিবাদকেও সাংবাদিক নেতারা পাত্তা দেননি। সাংবাদিকদের রুটি-রুজির দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগঠন সাংবাদিক ইউনিয়নকে রাখা হয়েছে দু’ভাগে বিভক্ত করে। ‘দুই সতিনের আলাদা সংসার’-এর মতো সাংবাদিক ইউনিয়নের অফিসে মধ্যখানে রয়েছে দেয়াল।
৩.
২০১৫ সালের ১১ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য নির্বাচনের জন্য ৭৯৫ জনকে মনোনয়ন দেয় ব্যবস্থাপনা কমিটি। তাদের মধ্যে ৪৬০ জনকে প্রাথমিক সদস্যপদ দেয়া হয়। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই শেষে ৩৩ জনকে বাদ দিয়ে ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর ৪২৭ জন সাংবাদিককে স্থায়ী সদস্যপদ দেয়া হয়। ইন্টারেস্টিং বিষয় যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী ফোরাম নিজ নিজ দলদাস সাংবাদিকদের তালিকা করেছেন এবং দুই পক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে ভাগ-বাটোয়ারা করে সদস্য নিয়েছেন। দুই পক্ষের সমর্থিতদের বাইরে যে আরো পেশাদার সাংবাদিক রয়েছেন, তা তাদের বোধগম্য হয়নি। কথিত আছে, অনেক নেতার ইচ্ছায় রেস্টুরেন্ট মালিক, ড্রাইভার, পিয়ন, নামসর্বস্ব পত্রিকার ব্যবসায়ী সাংবাদিককে সে সময় সদস্য করা হয়েছে। অথচ শুধু তৈলবাজি এবং তোষামোদি না করায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার দায়িত্বশীল পদে থাকা পেশাদার অনেক সিনিয়র সাংবাদিকের নাম কোনো পক্ষের তালিকায় ছিল না। ফলে তারা সদস্যপদ পাননি। সে সময় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন বঞ্চিতরা।
৪.
আমার সাংবাদিকতা শুরু ১৯৯২ সালে সিলেটে। রাজধানী ঢাকায় সাংবাদিকতার কর্মকাল প্রায় ২৬ বছর। সর্বশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি মামলার বোঝা টানতে হয়েছে। একজন রিপোর্টার হিসেবে অনেক বহুল প্রচারিত-আলোচিত দৈনিক সংবাদপত্রে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি সচিবালয়, পার্লামেন্ট, নির্বাচন কমিশন এবং ডিপ্লোমেটিক বিটে। একাধিকবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন, জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন, সার্ক সামিটসহ অনেক আন্তর্জাতিক ইভেন্ট কাভার করেছি। দায়িত্ব পালন করেছি অনেক পত্রিকার চিফ রিপোর্টার, হেড অব নিউজ, চিফ নিউজ এডিটর, এসোসিয়েট এডিটর, এক্সিকিউটিভ এডিটর হিসেবে। সর্বশেষ প্রায় ৩ বছর দৈনিক মানবকণ্ঠের সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম। এই ২৬ বছরে কমপক্ষে ৪ বার প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছি। দুই পক্ষের কাউকে কোনোদিন তোষামোদি করে বলিনি, আমাকে সদস্য করার জন্য। ফলে ২০১৬ সালের বিশাল বহরেও আমি সদস্যপদ পাইনি।
৫.
সর্বশেষ জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য হিসেবে বিশাল বহরের তালিকা প্রকাশের পর নিজের নাম না দেখে কিছুটা বিস্মিত হই, তবে মন খারাপ করিনি। কারণ বুঝতে পারি যে, নষ্ট রাজনীতির দোষে দুষ্ট সাংবাদিক নেতারা তাদের তল্পিবাহক ছাড়া কাউকে সদস্য করেননি। বিষয়টি আমাকে ব্যথিত করেনি, কারণ প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়ার সঙ্গে একজন পেশাদার-নিরপেক্ষ সাংবাদিকের কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তালিকায় অনেক অকর্মা-অপেশাদারদের নাম দেখে বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক নেতাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, আমি বাদ পড়লাম কেন? কোন যোগ্যতার অভাবে আমাকে সদস্য পদ দেয়া হয়নি? কেউ কেউ অনেকটা বিস্ময় ভাব দেখিয়ে বলেন, ‘নাম তো চূড়ান্ত তালিকায় ছিল, কীভাবে বাদ পড়লো জানি না!’ অবশ্য অফ দ্য রেকর্ড দুজন বলেছেন, তালিকা প্রকাশের আগ মুহূর্তে প্রভাবশালী একজন সিনিয়র নেতা কলম হাতে নিয়ে আমার নাম কেটে দিয়েছেন। এসময় উপস্থিত অনেকে আশ্বর্য হলেও প্রতিবাদের সাহস ছিল না। আমি বুঝতে পারি, কেন তিনি আমার নাম কেটে দিয়েছেন। সে বিষয়ে অন্যদিন লিখব। এরপর আর কখনো আমি এই ‘দলবাজ ক্লাব’-এর সদস্য হতে চাইনি, হইনি।
৬.
সিনিয়র সাংবাদিক আনিস আলমগীর সম্প্রতি তার এক পোস্টে লিখেছেন, ‘সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক, লজ্জাজনক যেটি তা আমার প্রফেশনে ঘটছে। পৃথিবীতে এমন দৃশ্য কোনো দেশে পাওয়া যাবে না। টেলিভিশন, পত্রিকার শীর্ষ কর্তারা পালিয়ে আছেন সরকারের পতনের পর। তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিংবা পুড়িয়ে দিয়েছে জনতা। তারা গোপনে দেশত্যাগ করেছেন কিংবা করতে চাচ্ছেন। যারা আগুনে ঘি ঢালতে প্রতিনিয়ত শেখ হাসিনাকে উস্কানি দিয়েছেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন, সরকার পতনের সঙ্গে ওরাও গর্তে লুকিয়ে গেছেন। সাংবাদিকতা কতটা দেউলিয়া পর্যায়ে গেলে এমনটি ঘটতে পারে একটি দেশে! পরিস্থিতি এখন যা চলছে তাতেও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করা যাবে কিনা কঠিন। যাই হোক, এই পরিপ্রেক্ষিতে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায়, একটি দেশের ইনস্টিটিউশনগুলো কতটা নষ্ট করা হলে, দলীয়করণ হলে জাতিকে এই দৃশ্য দেখতে হয়!’
৭.
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দায়িত্ব নেয়ার পর ৮ আগস্ট ২০২৪ ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সভায় ক্ষমতাধরদের হাতে অস্থায়ী সদস্য পদ থেকে বাদ পড়া ৪০ জন সদস্যকে পুনর্বহাল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিদ্ধান্তটি অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু দলবাজ নয়, কিংবা দুই পক্ষের সাংবাদিক নেতাদের তৈলবাজি না করায় কোনো পক্ষের তালিকায় নাম ছিল না, এমন অনেক সিনিয়র পেশাদার সাংবাদিক বারবার আবেদন করেও প্রেসক্লাবের সদস্যপদ পাননি। তাদের বিষয়েও নিশ্চয় ভাববেন বর্তমান নেতৃত্ব। ( বি. দ্র : তথ্যে ত্রুটি থাকলে সংশোধন করে দেওয়ার অনুরোধ )
লেখক: প্রাক্তন সম্পাদক, দৈনিক মানবকণ্ঠ

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- Payra Team