শুক্রবার | ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভয় দেখানোর সংস্কৃতি দিয়ে আর যা-ই হোক সংস্কার সম্ভব নয়

জুলহাস আলম: প্রথম আলো এর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম কে সচিবালয়ে হেনস্তা করা হলো, পরে গ্রেপ্তার করা হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমলে। তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম, প্রথম আলোর সাংবাদিকরা ও সাংবাদিকদের নানা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদ করেছিলেন। আমি নিজেও একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমার প্রতিষ্ঠানে স্টোরি করেছিলাম যা নিউইয়র্ক টাইমস সহ অনেক পৃথিবী বিখ্যাত সংবাদ মাধ্যম প্রকাশ ও প্রচার করেছিলো।

রোজিনার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এর ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা করেছিলাম, প্রকাশ্যে, বলেছিলাম এভাবে রোজিনাকে হয়রানি করা অন্যায়। সরকারি নথি নেবার অপরাধে তাঁকে আটকে রাখা হয় এবং পরে গ্রেফতার করা হয়। আমার ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে কিছু অনলনে মিডিয়া আবার নিউজও করে। প্রথম আলোর বেশ কয়জন সাংবাদিক আমাকে ধন্যবাদ জানান এ বিষয়ে উচ্চকিত হবার কারণে। অন্যদিকে আমাকে সতর্ক করা হয়, কোন একটা শক্তিশালী সংস্থা আমাকে হালকা “সতর্ক” করে, একদম সরাসরি না, অন্য মাধ্যমে। আমি বিনয়ের সঙ্গে আমার অবস্থান বলি। তারা বলেন, রোজিনা ইস্যু তে আমার অবস্থান এবং স্টোরি করার জন্য নাকি তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ “নোট” দিয়েছে। আমি শুনে হেসেছি। এবং সেটা উনারা সেখানেই শেষ করেছেন। ব্যাপারটা আমার কাছে পুরাই “আজাইরা” লেগেছে। যেহেতু আমার লেখা স্টোরি টা নিউইয়র্ক টাইমস সহ বিশ্বের অনেক নামকরা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে নাকি বাংলাদেশের “ভাবমূর্তি” ক্ষতি হয়েছে। ওটাই ছিল তাদের ইস্যু। আর কিছু না। এই তথাকথিত ভাবমূর্তি ইস্যু তাই আমার কাছে হাস্যকর লাগে।

রোজিনা জামিন পেলেন, আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। বললাম, সহকর্মী হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব ছিল।

কোন অহেতুক ভয় দেখানোর এমন সংস্কৃতি আমাদের সমাজে আছে, সাংবাদিকদের ভয় দেখানো একটা কালচার।

এখনও ভয় দেখানো হচ্ছে।

গণমাধ্যমে সরাসরি হামলা হচ্ছে। ভাংচুর হচ্ছে। নানা তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের নানা সংগঠনে তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে। সেই তালিকা দিয়ে নানা ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। অনেক সাংবাদিক, সম্পাদক কে নিয়ে গালিগালাজ করা হচ্ছে, টেলিভিশনগুলো কে নিয়ে নানা আজেবাজে কথা বলা হচ্ছে, চাপ তৈরি করা হচ্ছে, কিছু না বলে “ইশারায়” ভয় দেখানো হচ্ছে। ভাবটা এমন এই দেশের সকল অকাজের জন্য গণমাধ্যম দায়ী। হাস্যকর! সবাই ফেরেশতা, গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকগণ গণহারে ইবলিশ!

কী সুন্দর! কী চমৎকার!

সর্বশেষ সাংবাদিক শাকিল আহমেদ এবং ফারজানা রূপা কে গ্রেফতার করে চার দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। হত্যা মামলার অভিযোগে!

প্রতিবাদ জানাই। সরাসরি প্রতিবাদ জানাই। এটা নিপীড়নমূলক। যদি অন্য কোনো অভিযোগ দুজনের বিরুদ্ধে থেকে থাকে সেটা তদন্ত হতে পারে, সেই বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। তাতে কোন আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই। কিন্তু হত্যা মামলায় জড়িয়ে, তাদের কে রিমান্ড এ নেয়ার একটা অর্থ আছে, এবং সেটা পরিষ্কার: ভয় দেখানো। অন্যদের ভয় দেখানো।

মুখে সংস্কারের কথা বলে, এই ভয় দেখানোর খেলা সবাই বুঝে। গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার কাগজে কলমে করা আর তা বাস্তবে চর্চা করায় বিস্তর ফারাক।

রোজিনা এখন মুক্ত। যখনই দেখা হয়, ওর হাসিখুশি মুখ দেখে খুশি হই। পশ্চিমা অনেক সংগঠন থেকে সাহসী সাংবাদিকের স্বীকৃতি মিলেছে রোজিনার। রোজিনার হাউস প্রথম আলো। হত্যা মামলায় জড়িয়ে শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রূপা কে হয়রানি করার এমন চেষ্টার বিরুদ্ধে তাদের সরাসরি অবস্থান নেয়া উচিত। নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউমান রাইটস ওয়াচ ইতোমধ্যে মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবের সরকারের এমন আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্কারের কথা বলে এমন নিপীড়নমূলক আচরণ দিয়ে আর যাই হোক, কোনো একটা সরকারের ভালো করার সদিচ্ছা প্রকাশ পায়না। এসব প্রতিহিংসা মূলক। আইন উপদেষ্টা, আমার বহু দিনের পরিচিত জনাব আসিফ নজরুল সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। একটা ক্লারিফিকেশন দাবী করছি।

শাকিল আহমেদ এবং ফারজানা রূপাকে নিয়ে আমার প্রতিষ্ঠানে লিখেছি। যেমন আওয়ামী আমলে রোজিনাকে নিয়ে লিখেছিলাম। যারা রোজিনার সময় উচ্চকিত ছিলেন, তারা দেখি এখন অনেকেই ফিসফিস করে কথা বলছেন বা বলছেননা। তার মানে কী? আওয়ামী আমলের চেয়ে এখন তাদের মনে বেশি ভয়? নাকি অন্য কোনো বিষয়?

ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিষয়ক এমিরেটাস অধ্যাপক আলী রীয়াজ আওয়ামী অমলের নিপীড়ন নিয়ে ক্রমাগত লিখেছেন, বলেছেন। আমি নিজেও বেশ অনেকবার উনাকে ইন্টারভিউ করেছি যেখানে তিনি আওয়ামী সরকারের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন। তিনি ভয় দেখানোর সংস্কৃতি নিয়ে বই লিখেছেন। এখন তিনি কী ভাবছেন আমার তা জানার খুব ইচ্ছা।

রোজিনা নিজেই বা কী বলেন? তার অবস্থানটাই বা কী এখন? জানা নেই আমার।

দেখলাম সম্পাদক পরিষদ একটা বিবৃতি দিয়েছে। ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতন লেগেছে সেটা আমার কাছে। আমার এক সময়ের সম্পাদক, শ্রদ্ধেয় মাহফুজ আনাম এবং আমার প্রিয় মানুষ, দৈনিক বণিক বার্তার সম্পাদক হানিফ মাহমুদ ভাই পরিষদের নেতা হিসেবে এই বিবৃতি দিয়েছেন। সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এর পর কী?

লেখক: জুলহাস আলমের ফেসবুক থেকে নেয়া। তিনি খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও একই সঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাহী কমিটির নির্দলীয় নির্বাচিত সদস্য।

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- Payra Team