রিচার্ড সেমুর: ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জিতেছেন। সর্বপ্রথম ভোটার হয়েছেন এমন তরুণ, কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো ভোটারদের তিনি তাঁর পক্ষে টেনে জনমতকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ভোটসংখ্যা থেকে বোঝা যায়, রিপাবলিকানদের পক্ষে সুইংয়ের ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হলো ডেমোক্র্যাট ভোটারদের গণহারে ভোট দিতে না যাওয়া। ট্রাম্প এখন ভারত থেকে হাঙ্গেরি, ইতালি, ফিলিপাইন, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডস ও ইসরায়েল পর্যন্ত অতি ডানপন্থি সরকারগুলোর একটি ঢিলেঢালা জোটের নেতৃত্ব দেবেন।
হাঙ্গেরির ২০১০ সালের সংসদীয় নির্বাচনে ভিক্টর অরবানের ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে এই অতি ডানপন্থি সাফল্যের তরঙ্গ শুরু হয়েছিল। ২০১৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিজয়ের পর থেকে এটি খুব কমই থমকে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রথম আরোহণ, ব্রেক্সিট ভোট ও ফিলিপাইনে রদ্রিগো দুতের্তের সাফল্য; সবই ঘটেছিল ২০১৬ সালে। দুই বছর পর জেইর বলসোনারো ব্রাজিলে একটি হতাশাজনক অঘটন ঘটান। মহামারির পর ডানপন্থি ব্রাদার্স অব ইতালি ২০২২ সালে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং ২০২৩ সালে জাভিয়ের মিলেই আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপট ছাড়াও অন্যান্য কিছু ভেবে দেখে বলা যায়, ২০২০ সালে ট্রাম্পের এবং ২০২২ সালে বলসোনারোর পরাজয় ছিল এ পরিস্থিতিতে উত্থান-পতনের একটি পূর্বাভাসযোগ্য গতিধারা।
কেন ডানপন্থিরা বারবার জিতছেন? এর কারণ কি জেমস কারভিল যেমন বিল ক্লিনটনের ১৯৯২ সালের প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় বলেছিলেন সেই ‘এটা অর্থনীতি, বোকা? অতি ডানপন্থিদের বিজয়ের পেছনে আছে অর্থনৈতিকভাবে ‘পিছিয়ে রয়েছে’ এমন লোকেরা– এ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়।
এর ভেতর একটি গূঢ় সত্য আছে। ২০২৪ সালে ট্রাম্পের ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল অর্থনীতির বিদ্যমান বাজে অবস্থা। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভুল ধারণা ছিল– অর্থনীতি মন্দার মধ্যে আছে; উদারপন্থিরা যা এড়িয়ে গিয়ে বলার চেষ্টা করেছে, জিডিপি বাড়ছে এবং মুদ্রাস্ফীতি ২ দশমিক ৪ শতাংশে মোটামুটি স্থির। তবে এসব কথার সঙ্গে বেশির ভাগ লোকের অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার মিল ছিল না। মহামারির আগের তুলনায় জিনিসপত্রের দাম এখনও ২০ শতাংশ বেশি এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্যের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ২৮ শতাংশ বেড়েছে। গৃহস্থালি ঋণ একটি প্রধান উৎকণ্ঠার কারণ। বাইডেন মহামারিকালে চালু জনসাধারণের সুবিধাগুলোর একটি অংশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে বেশির ভাগ লোক মিডিয়ার এসব শিরোনামের পরিসংখ্যানে আস্থা রাখে না।
তবুও এসব ব্যাখ্যা বাস্তবতাকে সামান্যই স্পর্শ করেছে। প্রথমত, জনগণ সবসময় তাদের মানিব্যাগ মাথায় রেখে ভোট দেন না। ২০ শতক থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমীক্ষাগুলোতে দেখানো হয়েছে, অর্থনৈতিক ব্যক্তিস্বার্থের সহজ-সরল চিত্র ভোটের ভবিষ্যৎ গতি বোঝার খুব ভালো মাধ্যম নয়। অর্থনীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সামগ্রিক কল্যাণের একটি সাধারণ নির্ণায়ক হিসেবে নয়। এটি এমন একটি বিষয়, যেখানে মানুষ সমাজের অবস্থা তারা কীভাবে উপলব্ধি করে এবং তার সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হয়। সাধারণ ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোর তখনই রাজনীতিকীকরণ হয়, যখন সেগুলো একটি বৃহত্তর সংকটের অংশ হিসেবে দেখা হয়। দ্বিতীয়ত, যদিও চরম ডানপন্থিরা শ্রমিক শ্রেণির একটা অংশের সমর্থন ছাড়া জয়ী হতে পারে না; যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত ও ফিলিপাইনে এরা মধ্যবিত্তের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়াও লাখ লাখ লোক অতি ডানপন্থিদের পথে না হেঁটেও প্রতিনিয়ত তাদের অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংসপ্রাপ্ত। হতদরিদ্র লোকেরা আসলেই ডানপন্থিদের কথা গিলে না। তৃতীয়ত, কঠোরভাবে বিচার করলে আজকের অতি ডানপন্থিদের অর্থনৈতিক প্রস্তাব অন্তঃসারশূন্য। তার পরও ক্ষমতাসীনরা জাতীয়তাবাদীদের প্রতি অবিশ্বাস্য রকম উদার।
ডানপন্থার ফাটলগুলো উদারপন্থি ক্ষয় ও মনোবল হারানোর মতোই নিজস্ব বিষাক্ত আবেগীয় ক্ষরণের ফলস্বরূপ বেড়ে চলে। এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বামপন্থিদের নিজেদের পুনর্বিন্যস্ত করা প্রয়োজন।
রিচার্ড সেমুর: লেখক; দ্য গার্ডিয়ান থেকে