নিজস্ব প্রতিবেদক: শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র সংস্কার বা নির্বাচনী কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বললেও তারা একটি রোডম্যাপ দাবি করেছিলেন। তবে সরকার গঠনের তিন মাস পরেও কোনো রোডম্যাপ না দেওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতির অপসারণ, সংবিধান সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দলগুলোর সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে সরকারের। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বিএনপি সরকারের কাছ থেকে নির্বাচনী রোডম্যাপের চায়। দলটির নেতারা বলছে, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারই পারে রাষ্ট্র সংস্কার করতে। নির্বাচিত সরকার সংসদের মাধ্যমে সংবিধানের সংস্কার করবে। রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে গত সোমবার চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “সবচেয়ে বড় সংস্কার হচ্ছে নির্বাচনী সংস্কার। সব কথা শুনছি, নির্বাচনী সংস্কারের কথা শুনছি না। একটা কমিশন গঠন করেছে, আমরা খুশি হয়েছি। ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে, আমরা অপেক্ষা করছি।”
বিএনপি সূত্র জানায়, দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্র সংস্কারের যে ৩১ দফা দিয়েছিলেন তার ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাব রেখে আগামীতে নির্বাচনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হবে। এজন্য দলটি ৩১ দফার সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চায়। সেই লক্ষ্যে আগামী ১৪ নভেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে সেমিনার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্যসহ ৩১ দফা সেমিনারে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। পরবর্তীতে এই ৩১ দফার ভিত্তিতে জনমত গঠনের জন্য জেলায় জেলায় সভা সেমিনার করা হবে। এই সেমিনার থেকে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ চায় বিএনপি। যদি এর মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ না দেওয়া হয় তাহলে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন সরকার ইচ্ছা করলেই আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে। সোমবার তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা এমন অভিমত দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও বৈঠকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ মানুষের মৌলিক সমস্যা সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন। তারা মনে করেন এই সমস্য সমাধানের জন্য প্রয়োজন নির্বাচিত সরকার।
বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বলেন, নির্বাচনের জন্য তারা উপযুক্ত সময় দিতে চান সরকারকে। কিন্তু সেই উপযুক্ত সময় তো কয়েক বছর হতে পারে না। এ সময় প্রায় সব নেতাই মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ দেন।
সম্প্রতি কৃষকদলের এক অনুষ্ঠানে তারেক রহমান বলেন, “ভোট হতে হবে। ডামি নির্বাচন হতে পারবে না, দিনের আলোতে ভোট হতে হবে। এটা যদি নিশ্চিত করা যায়, ইনশা আল্লাহ ধীরে ধীরে দেশের সব সমস্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হব। ষড়যন্ত্র যদি রুখতে হয়, অবশ্যই ভোটার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।”
জানা গেছে, নভেম্বর মাসে ৩১ দফা নিয়ে সারাদেশে সভা সেমিনার আয়োজন করা হবে। এর পাশাপাশি নভেম্বর মাসজুড়ে দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের কাজ হবে। এরই মধ্যে মাসের শুরুতে ঢাকা মহানগর উত্তরসহ ১০ সাংগঠনিক জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। ছাত্রদল, যুবদল ও বিভিন্ন সংগঠনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার। নভেম্বরে কয়েকটি জেলার সম্মেলন হওয়ার কথাও রয়েছে। এছাড়াও ছাত্রদল, যুবদল তাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর করছে। তারা স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছে এবং বিএনপির ৩১ দফাসহ রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরছে। মূলত ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনের দাবিতে কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে দলটি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসেও বড় শোডাউন করবে। এছাড়া ইস্যুভিত্তিক কয়েকটি কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন,“তারেক রহমানের নির্দেশে আমরা সারাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপির রাষ্ট্র সংস্কারের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। গত তিনটি নির্বাচনে তরুণরা ভোট দিতে পারেনি, আগামীতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তারেক রহমান আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা ছাত্রদল দেশের প্রয়োজনে সব সময় প্রস্তুত রয়েছি। তারেক রহমানের নির্দেশ পেলে আমরা নির্বাচনের জন্য আবারো রাজপথে নামতে প্রস্তুত রয়েছি।”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, “বিএনপি সংস্কার চায়। কিন্তু সব সংস্কার তো এই সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন সংস্কার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন আয়োজন করা এই সরকারের প্রধান কাজ বলে মনে করি। তারপর নির্বাচিত সরকার এসে অন্যান্য সংস্কার করবে। আমাদের দলীয় ভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার দাবি জানাচ্ছি।”
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “তারেক রহমান যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সব দলের মতামতের ভিত্তিতে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন। অনির্বাচিত কোনো সরকার তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ও দর্শনের মাধ্যমে সেভাবে সংস্কার করার সুযোগ নেই। তবে যেসমস্ত সংস্কার ঐকমত্যে আছে সেগুলো বাস্তবায়নের আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা সংস্কার বাস্তবায়নে বিএনপি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, “১৬ বছরে জ্বলে-পুড়ে বিএনপি খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা ত্যাগ করতে শিখেছে, রক্ত দিতে শিখেছে ও জীবন দিতে শিখেছে। আমরা গণতন্ত্রের লড়াই, মানবাধিকারের লড়াই ও ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে থেমে থাকবো না।”