আল জাজিরা: যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) প্রধান হিসেবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ক্যাশ প্যাটেলকে বেছে নিয়েছেন দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী জানুয়ারিতে ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর তিনি সংস্থাটির নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন। তবে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত ঘিরে সমালোচনা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ক্যাশ প্যাটেলের যোগ্যতা নিয়ে। এমনকি এফবিআইপ্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
ক্যাশ প্যাটেলের বয়স ৪৪ বছর। ট্রাম্পের মতো তিনিও খোলাখুলিভাবে এফবিআইয়ের সমালোচনা করে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ‘ডিপ স্টেটের’ (রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র) অস্তিত্ব রয়েছে, এমন ধারণা জোরেশোরে প্রচার করে আসছেন তিনি। ডিপ স্টেট বলতে বোঝায়, কোনো দেশের সরকারের ওপর গোপনে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারি বা সামরিক কর্মকর্তাদের সংঘকে। ট্রাম্পকে নিয়ে এফবিআই পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করেন ক্যাশ। সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানোর পক্ষেও তিনি।
এদিকে এফবিআইপ্রধান পদে ক্যাশ প্যাটেলকে বেছে নেওয়ার মধ্য দিয়ে আরেকটি ইঙ্গিত দিলেন ট্রাম্প। সেটি হলো এফবিআইয়ের বর্তমান প্রধান ক্রিস্টোফার রে-কে তাঁর পদ থেকে সরানোর যে হুমকি এত দিন তিনি দিয়ে আসছিলেন, তা কার্যকর করতে চলেছেন। অথচ প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময় রিপাবলিকান দলের সমর্থন ক্রিস্টোফারকে নিয়োগ দিয়েছিলেন ট্রাম্প নিজেই। এফবিআইপ্রধান পদে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালে।
ক্যাশ প্যাটেল কে
ক্যাশ প্যাটেল হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নাম কাশ্যপ প্রমোদ বিনোদ প্যাটেল। তাঁর জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। অভিবাসী হিসেবে তাঁর মা-বাবা ভারতের গুজরাট রাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। ক্যাশ ইউনিভার্সিটি অব রিচমন্ড থেকে ক্রিমিনাল জাস্টিস অ্যান্ড হিস্টোরি বিষয়ে স্নাতক করেন। এ ছাড়া পেস ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে পড়াশোনা করেছেন তিনি।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৯ সালে মার্কিন প্রশাসনে যোগ দিয়েছিলেন ক্যাশ প্যাটেল। তখন তিনি ৪০ বছর বয়সী একজন আইনজীবী, সরকারি কাজে অভিজ্ঞতা ছিল কম। ট্রাম্প প্রশাসনে দ্রুত তাঁর উত্থান হয়েছিল। কিছু গণমাধ্যমের ভাষ্যমতে, ক্যাশের এই উন্নতির পেছনে ছিল, ট্রাম্পের প্রতি তাঁর পূর্ণ আনুগত্য। এমন খবরও শোনা গিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএর) উপপরিচালক পদে ক্যাশ প্যাটেলকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। এর জেরে তখন সংস্থাটির তৎকালীন পরিচালক জিনা হাসপেল পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ সব পদে কাজ করেছেন ক্যাশ প্যাটেল। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সন্ত্রাসবিরোধী বিভাগ দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। পরে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের চিফ অব স্টাফ পদে কাজ করেছেন। হোয়াইট হাউসে দায়িত্ব পালনের আগে ক্যাশ প্যাটেল মার্কিন কংগ্রেসের হাউস ইন্টেলিজেনস কমিটিতে ছিলেন। সেখানে তিনি ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ট্রাম্প কেন ক্যাশ প্যাটেলকে বেছে নিলেন
ট্রাম্প প্রায়ই এফবিআই ঘিরে নিজের অবিশ্বাসের কথা সামনে এনেছেন। সংস্থাটি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ তাঁর। ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোয় তাঁর বাড়িতে এফবিআইয়ের তল্লাশির পর এ অভিযোগ আরও জোরদার করেছিলেন তিনি। ওই তল্লাশিতে মার্কিন সরকারের গোপন নথি পাওয়া গিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, নথিগুলো অবৈধভাবে নিজের কাছে রেখেছিলেন ট্রাম্প।
সরকারি নজরদারি ও ‘ডিপ স্টেট’ নিয়ে ট্রাম্প ও ক্যাশ প্যাটেল—দুজনই সংশয় প্রকাশ করে আসছেন। ‘গভর্নমেন্ট গ্যাংস্টারস’ নামে ক্যাশ প্যাটেলের লেখা একটি বই রয়েছে। সেখানে তিনি কথিত ডিপ স্টেটের বিরুদ্ধে লিখেছেন। এফবিআই ও মার্কিন বিচার বিভাগ ঘিরে ট্রাম্প যে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চান, তাঁর সমর্থকেরা নির্বাচনে ক্যাশ প্যাটেলের পক্ষে ছিলেন।
ট্রাম্পের ভাষ্যমতে, ক্যাশ প্যাটেল এফবিআইয়ে ‘বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা ও সততা’ ফিরিয়ে আনবেন। সংস্থাটির দায়িত্ব পেলে আমেরিকায় ‘মহামারির মতো’ বেড়ে চলা অপরাধে লাগাম টানবেন তিনি। অভিবাসীদের অপরাধী চক্রগুলোকে ধ্বংস করে দেবেন। একই সঙ্গে মার্কিন সীমান্তে মানব ও মাদক পাচার বন্ধ করবেন ক্যাশ।
নিউইয়র্কে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার শুনানি চলাকালে অল্প যে কয়েকজন তাঁর সঙ্গে আদালতকক্ষে ছিলেন, তাঁদের একজন ক্যাশ প্যাটেল। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ট্রাম্প ‘অসাংবিধানিক সার্কাসের’ শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল বদলানোর চেষ্টার অভিযোগে করা মামলায় ট্রাম্পের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তিনি।
এফবিআইয়ের পরবর্তী প্রধান হিসেবে গত শনিবার ক্যাশ প্যাটেলের নাম ঘোষণা করেন ট্রাম্প। এরপর কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্রেটিক দলের সদস্য গ্যারি কনোলি ক্যাশকে একজন ‘গোঁড়া ব্যক্তি’ আখ্যায়িত করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লেখেন, ট্রাম্পের বেছে নেওয়া ‘অযোগ্য, বিপজ্জনক ও পুরোপুরি উদ্ভট’ একঝাঁক মানুষের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে খারাপ।
ক্যাশ প্যাটেলের দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও বিবৃতিতে তাঁর একটি সংকল্প ফুটে উঠেছে। সেটি হলো তিনি এফবিআইকে পুরোপুরি বদলে দেবেন এবং সংস্থাটির কাজকর্মে বড় পরিবর্তন আনবেন। ক্যাশের ভাষ্যমতে, এফবিআইয়ের কর্তৃত্ব সীমিত করতে চান তিনি। একই সঙ্গে যেসব সরকারি কর্মকর্তা সাংবাদিকদের কাছে তথ্য ফাঁস করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।
চলতি বছরের শুরুতে একটি সাক্ষাৎকারে ক্যাশ প্যাটেল বলেছিলেন, এফবিআইয়ের কার্যক্রম থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজকে বাদ দেবেন তিনি। এ ছাড়া ওয়াশিংটন ডিসির পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউয়ে এফবিআইয়ের প্রধান কার্যালয় বন্ধ করে দেবেন। সেখানে পরদিনই ‘ডিপ স্টেট’–বিষয়ক একটি জাদুঘর খুলবেন তিনি। আলাদা একটি সাক্ষাৎকারে ক্যাশ প্যাটেল বলেছিলেন, শুধু সরকারই নয়, গণমাধ্যম থেকেও ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করবেন।
তবে যতই বিতর্ক আর সমালোচনা থাকুক না কেন, ক্যাশ প্যাটেলকে নিয়ে ট্রাম্পের উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। সম্প্রতি নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি বলেছেন, ক্যাশ একজন মেধাবী আইনজীবী, তদন্তকারী এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগানের পক্ষের যোদ্ধা।