নুরুল্লাহ মাসুম: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক বোমা ফাটানো বক্তব্যে বলেছেন, সরকারের মেয়দ ৫ বছরের চেয়ে কম হওয়া উচিত। যদিও দলের আরেক প্রবীণ নেতা, ক্ষমতাধর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, আশরাফের মন্তব্য তাঁর ব্যাক্তিগত এবং এ বিষয়ে দলীয় ফোরামে কোন আলোচনা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আশরাফ আর কোন কথা বলেননি। আমি ব্যক্তিগতভাবে সৈয়দ আশরাফের মতামতকে স্বগত জানাই। আশা করি ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগ বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করবে এবং একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেবে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সম্প্রতি দলীয় কাউন্সিলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে নতুন কথা বলেছেন। তবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তরিত কোন ব্যাখ্যা দেন নি। এরশাদ সাহেবের আলোচনার সূত্র ধরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাই এবং আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বুঝি এবং ভাবি, সে বিষয়ে কিছু বক্তব্য তুলে ধরতে চাই।
বর্তমান সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি সকলের জানা। এ পদ্ধতির ভালো দিক যাই থাকুক না কেন, গ্রহণযোগ্যতা যাই-ই হোক না কেন, এর মন্দ দিক যে রয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রথমে আমি নির্বাচনের নতুন ধারণা নিয়ে বলতে চাই, পরে এর ভাল দিক এবং বর্তমান পদ্ধতির খারাপ দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
বর্তমান নিয়মে জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ৩০০ বহাল থাকবে। নির্বাচন হবে দলীয় ভিত্তিতে। অর্থাৎ সারা দেশের ভোটারগণ নিজ পছন্দের একটি দলকে ভোট দেবে। ভোটের পরে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত হিসেবে সংসদে আসন বন্টন করা হবে। নির্বাচন কমিশন হিসেব করে ঘোষণা করবে কোন দল কত আসন পেল। নির্বাচন কমিশনের এ ঘোষণার ১৫ দিনে মধ্যে আসন পাওয়া দলগুলো নিজেদের দলীয় ফোরামে (হতে পারে জাতীয় কাউন্সিলের আদলে) গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচন করবে।
জাতীয় নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ১ শতাংশ ভোট পেলেই একটি দল সংসদে ৩টি আসন পাবে-এ হিসেবে নির্বাচন কমিশন তাদের গেজেট প্রকাশ করবে। হিসেব মতে কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের ০.৩৩ শতাংশ পেলে একটি আসন পাবে সংসদে। দলীয় ভিত্তিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখানে নির্দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন করার সুযোগ থাকবে না। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে নিজ নিজ প্রতীক নিয়ে। জোটবদ্ধ নির্বাচন করারও কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর, গেজেটের মাধ্যমে সংসদের আসন সংখ্যা ঘোষিত হলে একাধিক দল জোট বেধে সরকার গঠন করতে পারবে।
একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে আইনের মধ্য দিয়ে। দলগুলো আসন সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর, দলীয় ফোরামে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সদস্য নির্বাচন করতে বাধ্য থাকবে। এতে করে, দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা যেমন বাড়বে, তেমনি কোন রাজনীতিবিদ কতটা জনপ্রিয় তাও প্রমানিত হবে। তা ছাড়া বর্তমান নিয়মে যে মনোনয়ণ বাণিজ্য চলে তাও বন্ধ হবে। এমনকি, নির্ধারিত সংসদীয় আসনে জনপ্রিয় হওয়া সত্তেও কেবল দলীয় প্রধান বা গুটি কয়েক দলীয় নীতিনির্ধারকদের কারণে মনোনয়ণ বঞ্চিত হবেন না ত্যাগী নেতাগণ।
নতুন প্রস্তাবিত নিয়মে দেশে কোন সংসদীয় আসন থাকবে না, সংসদ সদস্যগণ কোন এলাকার জন্য নির্বাচিত হবেন না। সংসদ সদস্য হবেন সমগ্র দেশের জন্য। তাঁদের কাজ হবে সংসদে আইন পাশ করা। দেশে প্রচলিত আইন নিয়ে পর্যালোচনা করা এবং জনপ্রশাসনের ওপর নজরদারি করা। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের জন্য কল্যাণকর সবকিছু করতে তারা সময় ব্যয় করবেন। বর্তমান নিয়মের নির্বাচনে একজন সংসদ সদস্য যেহেতু একটি এলাকা থেকে নির্বাচিত হন, সে কারণে তাঁকে এলাকার জন্য কিছু করতে হয়, আগামীতে ভোট পাওয়ার আশায়। এছাড়াও তাদের কারো কারো ক্ষমতালিপ্সুতার কারণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারে না। এখনতো আবার সংসদ সদস্যদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে এমনভাবে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, তাঁরা সংসদে বসবেন না স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে কাজ দেখবেন, সেটা নিয়ে ভাবতে হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়ে জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সংসদ সদস্যদের দিয়ে মনিটরিং কমিটি করে দেয়া হলে তাদের কাজগুলো ভালভাবে তদারকি করা সম্ভব হবে বলে মনে করি। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা ভাল পরামর্শ দিতে পারবেন।
প্রস্তাবিত নতুন নিয়ম ধরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে রাজনীতিতে পেশীশক্তির মহড়া কমবে। একজন সংসদ সদস্য যখন কোন একটি বিশেষ এলাকা থেকে নির্বাচিত হবেন না, তখন এলাকায় স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখার দরকার হবে না। তৈরী হবে না মাসল্ গ্রুপ। এর বদলে নেতারা নিজ দলের ভেতরে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য সত্যিকার অর্থে কল্যাণকর কাজ করতে আগ্রহী হবেন। সংসদ সদস্যগণ এলাকা ভিত্তিক হবেন না বলেই তদবির পার্টির অভ্যুদয় ঘটবে না। রাজনীতিতে সত্যিকার একটি শান্ত পরিবেশ গড়ে উঠবে। রাজনীতি হয়ে উঠবে কল্যাণের জন্য এক মহান কাজ। অন্য দিকে গণতন্ত্রের আরো বিজয় ঘটবে। জাতীয়ভাবে ছোট ছোট দলগুলো সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে। আমাদের দেশে বহু দল আছে যারা মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট পেয়েও বর্তমান নিয়মের কারণে সংসদের কোন আসন পায়নি কোন কালেই। আবার কোন কোন দল প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে অতি নগণ্য সংখ্যক আসর পেয়েছে অতীতে। অথচ সংখ্যানুপাতে নির্বাচন হলে সংসদে তাদের আসন বাড়তো। একটা বিষয় সকলের কাছে পরিস্কার, সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ক্ষমতাশীন দলের মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাব এসে যেতে পারে। এসব কারণে নতুন নিয়মে ভোট নেয়া হলে ছোট ছোট দলগুলোর সংসদে উপস্থিতি যেমন বাড়বে তেমনি বড় দলগুলোর ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য কমবে।
এবার দেশের কয়েকটি নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে দেখি। আমরা দেখতে পাব, সংখ্যানুপাতে নির্বাচন পদ্ধতি চালু থাকলে সংসদের চেহারা কেমন হতে পারতো।
২০০১ এর নির্বচিনে বিএনপি’র প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪১.৪০ শতাংশ। সংখ্যানুপাতে তাদের আসন হতে পারতো ১২৪টি। বর্তমান নিয়মে তারা পেয়েছিল ১৯৩টি আসন। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪০.০২ শতাংশ। সংখ্যানুপাতে নির্বাচন হলে তাদের আসন সংখ্যা হতো ১২০টি। তারা পেয়েছিল মাত্র ৬২টি। জামাত মাত্র ৪.২ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল ৪টি, সংখ্যানুপাতের নির্বাচনে তাদের পাওয়া উচিত ছিল ১২টি আসন।
একইভাবে ২০০৮ এর সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট ৪৯ শতাংশ, আসন হতে পারতো ১৪৭টি, কিন্তু তারা পেয়েছে ১৬৮টি আসন। বিএনপি’র প্রাপ্ত ভোট ৩৩.২শতাংশ, সংখ্যানুপাতে তারা পেতে পারতো ৯৯টি আসন, বাস্তবে তারা পেয়েছে মাত্র ৩০টি আসন। এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রাপ্ত ভোট ৭ শতাংশ। তারা পেয়েছে ১৬টি আসন। সংখ্যানুপাতে নির্বাচন হণে তাদের আসন হতো ২১টি। অন্যদিকে বিজেপি মাত্র ০.১ শতাংশ ভোট পেয়েও ১টি সংসদসীয় আসন পেয়েছে, সংখ্যানুপাতে নির্বাচন হলে তাদের আসন পাওয়ার কোন সুযোগ থাকতো না।
এবারে দেখা যাক ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের অবস্থা কি ছিল। তখন আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৩.৬৬ শতাংশ ভোট, আসন পেয়েছিল ২৭৬টি। সংখ্যানুপাতের হিসেবে তাদের তখন পাওনা ছিল ২২০টি আসন। সে সময়ে ন্যাপ (মোজাফ্ফর) ৮ শতাংশেরও বেশী ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল মাত্র ২টি। সংখ্যানুপাতে তাদের পাওনা হয়েছিল ২৪টি আসন। ভাসানী ন্যাপও ১টি আসন পেয়েছিল তখন, অথচ তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫ শতাংশের বেশী, তারা পেতে পারতো ১৫টি আসন। জাসদ পেয়েছিল ৬.৪৩ শতাংশ, সংসদের তাদের আসন ছিল ১টি, তারা পেতে পারতো ১৯টি আসন। সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে নির্বাচন হলে দেশের ও জনগণের জন্য কি সুফল বয়ে আনবে তা পরিস্কার করে বলার কোন দরকার আছে বলে মনে হয় না। আমি মনে করি আমার এ প্রস্তাব নিয়ে দেশের ছোট ছোট দলগুলো এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী জনমত গঠন করতে এগিয়ে আসবেন। সংসদে যত বেশী পথ ও মতের সদস্য থাকবে, সংসদ তত বেশী কার্যকর হবে বলে আমি মনে করি। আমি মনে করি, নতুন নিয়ম চালু করা গেলে দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যাও কমে আসবে। সংসদে আসন পাওয়ার আশায় একেবারে ছোট ছোট দলগুলো মিলে একটি দল গঠনে এগিয়ে আসতে পারে।
সংসদ সদস্যগণ সরকার পরিচালনায় সম্মানজনক ভূমিকাও রাখতে পারবেন। বর্তমানে সংসদীয় বিভিন্ন কমিটির প্রধান হিসেবে বিরোধী দলের সদস্যরা রয়েছেন। নতুন নিয়মে সংসদ গঠিত হলে, সংসদ সদস্যগণ আরো বেশী করে জনপ্রশাসন দেখ্ভালে সময় দিতে পারবেন। সংসদ সদস্যগণ এলাকায় গম বিতরণ বা ভিজিএফ কার্ড বিতরণে যাবেন না বা যাওয়ার দরকার হবে না। সে কাজ করবে স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ।
আমার এ ছোট্ট প্রস্তাবনা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভেবে দেখবে এবং সুধী সমাজ এর ভাল দিকগুলো নিয়ে জনতার সামনে এগিয়ে আসবেন এটাই কাম্য।
রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গে বর্তমান চিন্তা-ভাবনা:
১. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট: একটা হাতী পালতেই গলধঘর্ম, দুটো কেন? ওদের খরচ জনগণের মাথায় ভাঙ্গার চিন্তা কেনো?
২. উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ কি কাজে লাগবে, জনগণের ঘাড়ে ট্যাক্সের বোঝা বাড়ানো ছাড়া?
৩. প্রদেশ সৃষ্টি করে অনেকগুলো স্থানীয় সংসদ গড়ে সেই জনগণের ঘাড়েই তো ট্যাক্স বসানো হবে! তাছাড়া বিচ্ছিন্নতাবাদীরা উৎসাহিত হতে পারে! ওপথে না যাওয়াই ভালো।
৪. স্থানীয় সরকার (জেলা ও উপজেলা পরিষদ) ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে সুশাসন কায়েম করা সম্ভব। এতেকরে শহরকেন্দ্রীক নির্ভরশীলতা কমবে- বর্তমান ব্যয়ের মধ্যে থেকেই।
৫. আমেরিকান বা ব্রিটিশ স্টাইলে চিন্তা না করে বাংলাদেশী কায়দায় সংবিধান ও রাষ্ট্র সংস্কারের চিন্তা করাটাই যৌক্তিক বলে মনে করি।