সোমবার | ১৬ জুন, ২০২৫ | ২ আষাঢ়, ১৪৩২

তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্রে কারও অংশ না নেওয়ার কারণ জানতে চাইছে পেট্রোবাংলা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আহ্বান করা আন্তর্জাতিক দরপত্রে কোনো বহুজাতিক কোম্পানি অংশ না নেওয়ার কারণ জানতে কমিটি গঠন করেছে পেট্রোবাংলা। গত সপ্তাহে পেট্রোবাংলার পরিচালককে (প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট-পিএসসি) প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী এক মাসের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা শেষে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক আছে। অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান চালাচ্ছে ভারতের কোম্পানি ওএনজিসি। আর ২৪টি ব্লকে দরপত্র ডাকা হয়েছিল গত ১১ মার্চ। দরপত্র জমার জন্য ৬ মাস (৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সময় দেওয়া হয়েছিল। সময় শেষ হওয়ার আগেই কোম্পানিগুলোর অনুরোধে পুনরায় ৩ মাস বাড়িয়ে ৯ ডিসেম্বর করা হয়। মার্কিন কোম্পানি এক্সোন মবিল, শেভরনসহ ৭টি আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা কোম্পানি দরপত্র কিনেছিল এবং দুটি কোম্পানি পেট্রোবাংলা থেকে ডাটা কিনেছিল; কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউই দরপত্র জমা দেয়নি।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, সাতটি বহুজাতিক কোম্পানি দরপত্র কিনলেও কেন জমা করল না তার কারণ জানতে কমিটি করা হয়েছে। দরপত্র আহ্বানের পর সভা, সেমিনার ও বৈঠক হয়েছে, সেখানে কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে যেসব বিষয় সামনে এসেছিল সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। আবার আমাদের মডেল পিএসসিতে (উৎপাদন বণ্টন চুক্তি) কোনো সমস্যা আছে কি-না সেগুলোও যাচাই করবে কমিটি। প্রয়োজনে তারা কনসালট্যান্টের (উড ম্যাকেঞ্জি) সঙ্গে কথা বলবে। উড ম্যাকেঞ্জি আমাদের পিএসসি প্রণয়নের পরামর্শক ছিলেন। তিনি বলেন, পেট্রোবাংলার সদস্যকে (পিএসসি) প্রধান করে গত সপ্তোহে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যদি রি-টেন্ডার করার সুযোগ থাকে তাহলে রি-টেন্ডার করা হবে। আর যদি পিএসসি রিভিউ করতে হয়, তাহলে সেভাবে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।

কেন দরপত্র জমা দেয়নি এর কোনো কারণ জানতে পেরেছেন কি না প্রশ্ন করা হলে চেয়ারম্যান বলেন, কোনো কোম্পানি সেভাবে কিছু জানায়নি।

আমাদের কমিটি প্রতিটি কোম্পানির সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করবে এবং জানান চেষ্টা করবে কেন তারা অংশ নেয়নি।

পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ও মডেল পিএসসি ২০০৮ প্রণয়ন কমিটির প্রধান মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, গ্যাসের মূল্য বাড়ালেই কোম্পানিগুলো দরপত্রে অংশ নেবে, সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেন দরপত্র জমা পড়েনি এবং কেন মাত্র সাতটি কোম্পানি দরপত্র কিনেছিল তা খতিয়ে দেখা দরকার। তিনি বলেন, পিএসসিতে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। পিএসসিতে শর্ত দেওয়া হয়েছে দৈনিক ২০ হাজার ব্যারেল (তেলের সমান) গ্যাস উত্তোলন করে এমন কোম্পানি দরপত্র কিনতে পারবে। এই শর্তের কারণেই অনেক কোম্পানি বাদ পড়ে গেছে। আমি মনে করি গভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ১০ হাজার এবং অগভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ৫ হাজার ব্যারেল হওয়া উচিত। তাহলে আরও অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিতে পারবে। তিনি বলেন, আমরা যখন ২০০৮ সালে পিএসসি প্রণয়ন করি তখন ১৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দিতে চেয়েছিলাম। একটি বিদেশি কোম্পানি এসে আমাদের বলল ২৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দেওয়ার জন্য। আমরা রাজি না হলেও মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ হাজার করা হয়েছিল। আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ডাটা প্যাকেজের দাম অনেক বেশি। কোনো কোনো প্যাকেজের দাম মিলিয়ন ডলারের মতো। অন্য দেশে এসব ডাটা ফ্রি দেয়। ১৯৭৪ সালে আমাদের দেশে এসব ডাটা উন্মুক্ত ছিল, তখন অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিয়েছিল।

পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্যই আকর্ষণীয় করা হয়েছে পিএসসি। আগের পিএসসিগুলোতে গ্যাসের দর স্থির করা দেওয়া হলেও উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি)-২০২৩ এ গ্যাসের দর নির্ধারিত করা হয়নি। ব্রেন্ট ক্রুডের আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে উঠানামা করবে গ্যাসের দর। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৯০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ৯ ডলার। তেলের দাম বাড়লে গ্যাসের দামও বাড়বে, কমলে এটিও কমবে। এখন তেলের দাম ৭০ থেকে ৭২ ডলার, এতে গ্যাসের দাম হবে ৭ থেকে ৭ দশমিক ২ ডলার। দরপত্র ডাকার সময় তেলের দাম ছিল ৯০ ডলারের বেশি।

বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল ও শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, নরওয়ে ও ফ্রান্সের যৌথ কোম্পানি টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জার, জাপানের ইনপেক্স করপোরেশন ও জোগম্যাক, চীনের সিনুক, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি এবং ভারতের ওএনজিসি আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এরমধ্যে সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছিল শেভরন, এক্সনমবিল, ইনপেক্স, সিনুক ও জোগোম্যাক। শেষ পর্যন্ত তাদের কেউ আসেনি দরপত্রে।

সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। ২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ ব্লকে কাজ নেয় কনোকো ফিলিপস। তারা টু-ডি জরিপ শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি করে। সেই দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায়। এ ছাড়া চুক্তির পর কাজ ছেড়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ার স্যান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। সর্বশেষ মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল গত ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আগে বঙ্গোপসাগরের সব ব্লক ইজারা চেয়ে দেনদরবার করে; কিন্তু ওই সময় ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সব ব্লক ইজারা দিতে চায়নি। তারপরও এক্সনমবিলের প্রতিনিধি দল ব্লক ইজারার বিষয়ে ঢাকা সফর করে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি আপডেট করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি।

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- SHUMANBD.COM