রবিবার | ১৫ জুন, ২০২৫ | ১ আষাঢ়, ১৪৩২

চাকরি হারিয়ে দিশাহারা বেক্সিমকোর ৫০ হাজার শ্রমিক

নিউজ ডেস্ক: এ সময় তাঁর কাছে চকোলেট কিনে দেওয়ার বায়না ধরল সাত বছরের ছোট মেয়ে। মা মিথ্যা গল্প শুনিয়ে মেয়েকে ভোলানোর চেষ্টা করলেন।
মিথ্যা প্রবোধ দিতে গিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়াল চোখ থেকে। নীরব বেদনার এই দৃশ্যপটে জ্বলজ্বল আচমকা চাকরি হারানোর নির্মম বাস্তবতা।

চিত্রটি গাজীপুরের মামুন নগরটেকের বাসিন্দা মালা রানীর উঠানের। কিছুদিন আগেও স্বামীহারা এই নারীর একরকম চলে যাচ্ছিল সংসার। এখন তিনি নিরুপায়।

স্বামীর অকালমৃত্যুর পর দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন মালা। কাজ নেন পতিত সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কারখানায়। লুটপাটের কারণে বেক্সিমকোর শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ায় তিনি এখন বেকার।

আয় না থাকায় এখন জীবনযুদ্ধে দুই সন্তানকে নিয়ে তাঁর টিকে থাকাই দায়।

মেয়েটি চকোলেটের কথা ভুলে খেলতে যাওয়ার পর আর বাঁধ মানল না অশ্রু। এই প্রতিবেদকের সামনে অঝোরে কেঁদে ফেলেন মালা। বললেন, ‘অকালে স্বামী হারাইলাম। দুই ছেলেমেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব এখন আমার।

ওগোর ভবিষ্যতের কথা ভাইবা অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আইছি। ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শিখাইয়া ওগোর মানুষ করমু। কারখানা বন্ধ হইয়া গেল দুই মাস আগে। চাকরি নাই, বেতন নাই, দোকানদারও বাকি দেয় না। প্রতিদিন বাসাভাড়ার জন্য তাগাদা দেয় বাড়িওয়ালা। ’

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘এখন আমাগোর কী হইব? শুনলাম, কারখানা থাইকা ছয় হাজার ৫০০ টাকা দিব। এই টাকা দিয়া কী করমু? বাসাভাড়া দিমু, না খামু?’

শুধু মালা রানীর ঘরেই নয়, আশপাশের ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের বাড়িতে কান্নার এই করুণ সুর। কাজ হারিয়ে সবাই এখন বেকার। নতুন কাজের চেষ্টা করে বিফল হয়ে অনেকে এরই মধ্যে ফিরে গেছেন নিজ নিজ ঠিকানায়। এলাকার একটি টিনশেড বাড়ির ১৩টি ঘরের ৯টিতেই দেখা গেল তালা। জানা গেছে, তাঁরা প্রত্যেকেই বেক্সিমকোর কারখানায় কর্মরত ছিলেন।

এলাকার অনেক মুদি দোকানি এসব শ্রমিক পরিবার থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে পারছেন না। কাজ নেই, টাকা দেবেন কিভাবে? বাড়িওয়ালা, মেসের রান্নাবান্নার খালা—তাঁরাও একই সমস্যায়।

ভাই-বোন স্টোরের মুদি দোকানি ফরিদা পারভীন বলেন, ‘বেক্সিমকো বন্ধ হওয়ায় আমরাও বিপাকে পড়ছি। অনেকেই বাড়ি চইলা গেছে। যারা আছে, টাকা না থাকায় পাওনা দিতে পারতাছে না। আমিও দোকানে মাল তুলতে পারতাছি না। ’

মামুননগরে শিঙাড়া-সমুচার ফেরিওয়ালা ওমর ফারুক বলেন, ‘কারখানা বন্ধের পর ৮০ শতাংশ শ্রমিক এইখান থিকা গ্রামে চইলা গেছে। মহল্লায় মানুষ নাই। আমাগোর বেচার জায়গা নাই। কারখানা চালু থাকলে আমাগোর সংসারটাও তাদের মাধ্যমে চলে। এখন একেবারেই বেচাকেনা নাই। ’

মামুননগরের মোস্তফা কামাল নামের এক বাড়িওয়ালা বলেন, ‘অনেকেই চলে গেছে। অন্যরা দুশ্চিন্তায় আছে—কারখানা আর খুলবে কি না। তারাও চলে যাবে। আমরা টেনশনে আছি— কারখানা বন্ধ হলে ভাড়াটিয়ারা চলে যাবে। অনেকে তো বাড়িভাড়ার টাকা দিয়েই সংসার চালায়। ’

বেক্সিমকো থেকে ছাঁটাই হওয়া পোশাক শ্রমিক নাজমুল বলেন, ‘আমরা কারখানাটারে একটা পরিবার মনে করি। কারখানা যাতে ভালো কইরা চলে, সেইভাবে কাজ করি। আমাগোর ওপর ভরসা কইরাই মালিকরা বড় কারখানা চালাইতে পারে। কারখানার মাধ্যমে তাগোর অবস্থা ঠিকই ভালো হয়, কিন্তু তারা আমাগোর কথা চিন্তা করে না। আমাদের জমা টাকাটাও মাইরা খায়। আমাগোর প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটাও পাইতেছি না। সেইটা পাইলেও গ্রামে গিয়া কিছু করতে পারি। ’

সরকার পরিবর্তনের পর গত কয়েক মাসের মধ্যে বড় ধরনের আঘাত এসেছে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ওপর। বেক্সিমকো শিল্পগোষ্ঠী তাদের ১৫ পোশাক কারখানার প্রায় ৪০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। এ জন্য গাজীপুরে রপ্তানিমুখী পোশাক ও বস্ত্র কারখানাগুলো কার্যাদেশ পায়নি—এমন কারণ দেখিয়েছে। শ্রমিকদের ভাষ্য, অর্ডার এলে মালিকপক্ষ নিজেরাই তা ফেরত দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। গত ১৫ ডিসেম্বর জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে শিল্পগোষ্ঠীটির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিককে ১৬ ডিসেম্বর থেকে ছাঁটাই কার্যকরের কথা জানানো হয়।

বেক্সিমকোর অর্থ ও করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী বলেন, কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলতে না পারায় উৎপাদন চালানো যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রথমত একটি চলমান প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে—এটা ঠিক নয়। এটা প্রশাসক বসিয়ে হোক বা একটা ম্যানেজমেন্ট করে দিয়ে হোক, এটা চালু রাখতে হবে। আর যদি বন্ধই করতে হয়, তাহলে সব সম্পদ বিক্রি করে হলেও শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করতে হবে। শুধু পাওনা দিলেই হবে না, আশপাশের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বসে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ব্যবসাকে রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে। যাতে রাজনীতিকরণের কারণে শ্রমিক বা সাধারণ মানুষকে সাফার করতে না হয়।

বেক্সিমকো গ্রুপের ১৫টি কারখানার মধ্যে রয়েছে শাইনপুকুর গার্মেন্টস, আরবান ফ্যাশনস, ইয়েলো অ্যাপারেলস, প্রিফিক্স ফ্যাশনস, আরআর ওয়াশিং, বেক্সিমকো ফ্যাশনস, বেক্সিমকো গার্মেন্টস, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস, এসেস ফ্যাশনস, এসকর্প অ্যাপারেলস, ক্রিসেন্ট ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন, ক্রিসেন্ট অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড ইত্যাদি।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- SHUMANBD.COM