শনিবার | ১০ মে, ২০২৫ | ২৭ বৈশাখ, ১৪৩২

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে ছাত্ররা কী চায়

নিজস্ব ডেস্ক: একটি সাম্প্রতিক সন্ধ্যায় এক বাণিজ্যিক ভবনের প্রথম তলায় দেখা যায় একেবারে একটি নতুন অফিসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের একটি দল বাংলাদেশের জন্য নতুন ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করছিল।

বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র হিসেবে পুনর্গঠন করার জন্য ছাত্ররা এখন বদ্ধপরিকর— এটি যত দীর্ঘস্থায়ী হোক বা প্রক্রিয়া যতই অগোছালো হোক। তারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এমন একটি ব্যবস্থা কল্পনা করে যা কোনো নেতার পক্ষে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

২৬ বছর বয়সী ছাত্র সংগঠক আরিফ সোহেল বলেন, আমরা এমন একটি দেশ চাই, যা ছাত্র ও জনগণের জীবনকে স্থিতিশীল এবং অগ্রগতি করবে।

বাংলাদেশের জন্য সংস্কার একটি দুঃসাধ্য কাজ। এই সংস্কার বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চেপে পড়েছে, যারা প্রচুর চাপ সহ্য করে কাজ করে যাচ্ছে। হাসিনার অধীনে দমন করা একটি প্রধান রাজনৈতিক দল (বিএনপি) দাবি করে আসছে যে, কোনো সংস্কার আনুষ্ঠানিক হওয়ার আগে, কয়েক মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করা।

অবসাদগ্রস্ত নাগরিকরা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, যা তেল ও চালের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনের বিক্ষোভে রাজধানী ঢাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর মুসলমানদের হামলার খবরের মধ্যে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়েছে। এমনকি জঙ্গি পুনরুত্থানের আশঙ্কাও রয়েছে।

যদিও পুরানো সিস্টেমটি দ্রুত উচ্ছেদ করা হয়েছিল, এটি সংশোধন করতে সময় লাগবে এবং এখন দায়িত্বরত ছাত্র এবং টেকনোক্র্যাটদের সেই সময় সুযোগ হয়তো নাও থাকতে পারে।

বাংলাদেশের অগ্রগতির ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের প্রধান ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘সংস্কার চলমান।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরের সময়কে উল্লেখ করে মাহফুজ আলম বলেন, দুই মাস আগেও যখন সরকার শুধু আইন-শৃঙ্খলার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল, তখন সংস্কার স্থবির ছিল। এই মুহূর্তে এটি চলমান এবং অর্থনীতি ঠিক করছে।

২৬ বছর বয়সী মাহফুজ আলমকে বলা হয় বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের কৌশলবিদ। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসনের বিলুপ্ত ও নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধারণা ছিল ছাত্রদের মূলমন্ত্র।

মাহফুজ আলম আরো বলেন, নতুন সরকার নির্বাচনী বিধিমালা হালনাগাদ করার মতো আরও দৃশ্যমান, স্বল্পমেয়াদি সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে। সরকারে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের তরুণ জনসংখ্যার জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো চ্যালেঞ্জ হাতে নেয়া হয়েছে, যাতে কিছু সময় লাগবে।

একটি সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস বলেন, তার সরকারের ওপর জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। যদিও তিনি সংস্কার নিয়ে ধীরগতির জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছেন। ‘তারা (ছাত্ররা) বলেনি- আমরা আপনাকে চাই না,’ তিনি বলেন।

ড. ইউনুস জানান, সংস্কারে বেশ কয়েক বছর সময় লাগতে পারে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা ‘বাংলাদেশ ২.০’ গঠনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

‘নৈতিক দায়িত্ব’:

৭৮ বছর বয়সী অর্থনীতিবিদ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার ব্যবস্থার দায়িত্ব পান। সংবিধান সংস্কার কমিশনের দায়িত্বে থাকা ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রিয়াজের জন্যও এই রকম অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তিনি তার কাজকে ‘নৈতিক দায়িত্ব’ বলে মনে করেন।

ড. রিয়াজ বলেন, তার লক্ষ্য বাংলাদেশের সংবিধানকে পুনরুদ্ধার করা, যেখানে এটি ‘সমতা, মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠা পায়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আশা করে, বিস্তৃত সংস্কার কার্যকর করা হবে, জনসাধারণের কাছ থেকে ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য সমর্থন দেওয়া হবে এবং পরবর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে- এমন রাজনীতিবিদদের সুযোগ করে দেওয়া।

বদিউল আলম মজুমদারের কমিশন এমন ব্যবস্থা বিবেচনা করছে, যা বাংলাদেশি প্রবাসীদের ভোট দিতে, মহিলা ভোটারদের মধ্যে ভোটার বৃদ্ধি এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার অনুমতি থাকবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান, যিনি কয়েক দশক ধরে অবৈধ অর্থের প্রবাহ ট্র্যাক করে আসছেন, বিদ্যমান দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার দাবি জানান তিনি।

সবচেয়ে বেশি দরকার হলো সঠিক লোকেদের সঠিক জায়গায় বসানো ও খারাপ লোকেদের সরিয়ে দেওয়া, যা একটি ‘ম্যামথ’ কাজ বলে উল্লখ করেন ইফতেখার জামান।

সর্বত্র চাপ:

বাংলাদেশের আইনজীবী এবং হিন্দু নেতা গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক ভারত এবং অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশি সরকারের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার কারণে মাঝপথে আটকা পড়েছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা আগস্টে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশিদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বেড়েছে। গত সোমবার অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা অনুরোধটি পেয়েছেন, কিন্তু এ বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য নেই।

একটি সাম্প্রতিক ইউটিউব ভিডিওতে শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকে বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর ‘নির্যাতন’ চালানোর সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য অভিযুক্ত করেন, যেখানে দক্ষিণপন্থী ভারতীয়রা তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেন।

গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক এ ধরনের অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বিরল। তিনি ইউনূস সরকারের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।

এরপরও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, গত মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার একজন হিন্দু সন্ন্যাসীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে বলেছে, তিনি জাতীয় পতাকার অসম্মান করেছেন। কিন্তু ভারত বলেছে- বাংলাদেশ হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য বৈধ দাবি করা একজন ধর্মীয় নেতাকে টার্গেট করেছে।

ড. ইউনূস এক সাক্ষাৎকার বলেন, ভারত যদি হাসিনাকে রাখতে চায় রাখুক। কিন্তু তাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, সে আমাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না।

দেশটির আরেক প্রধান দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি যা অন্তর্বর্তী সরকারের চাপের আরেকটি বড় উৎস।

বিএনপি বলছে, ইউনূস সরকার নির্বাচন বা সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য একটি রোডম্যাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব ধীর গতিতে কাজ করছে। গত সপ্তাহে, ইউনূস বলেছিলেন যে, প্রস্তাবিত সংস্কারের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে ২০২৫ সালের শেষদিক থেকে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন হওয়া উচিত। কারণ একটি অনির্বাচিত সরকার অনেক সমস্যার সম্মুখীন হবে। তিনি অটোরিকশা চালকদের অতিরিক্ত ভাড়াসহ ঢাকা ও অন্যান্য শহরে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ ও বিক্ষোভের দিকে ইঙ্গিত করেন।

ডাবল ডিজিটের মুদ্রাস্ফীতি আরেকটি অতিরিক্ত চাপ। সম্প্রতি এক সকালে প্রায় ১০০ জন নাগরিক ঢাকায় টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, যেখানে ভর্তুকি মূল্যে তেল, চাল এবং শাকসবজি বিক্রি হচ্ছিল। নাসিমা নামে একজন দর্জি বলেন, আপনি এখান থেকে যতটা চান নিতে পারবেন না। আমাকে বাজার থেকে দ্বিগুণ দামে কিনতেই হবে।

ভবিষ্যৎ:

গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুর হাজার হাজার মূর্তি ভেঙে ফেলে বা বিকৃত করে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের নেতা ড. রিয়াজ এ ব্যাপারে বলেন, শিক্ষার্থীরা বলেছিল তিনি (বঙ্গবন্ধু) দেবতা নন। কিন্তু যে ক্ষোভের ইন্ধন একসময় ভাংচুরের অকল্পনীয় দৃশ্য ছিল তা এখন ঠান্ডা হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।

কেউ কেউ নিশিতা জামান নিহার মতো সুযোগ পেলে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে চান। এমনকি উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, তিনি ভাষা ও ইতিহাস আরো বেশি করে শিখতে চান। যদিও আপাতত তারা রাজনীতিকে ভালোর জন্য একটি শক্তিতে পরিণত করার দিকে মনোনিবেশ করছেন।

ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আসিফুল হক রবিন বলেন, আমরা যা করার চেষ্টা করছি তা হলো বাংলাদেশে রাজনীতির জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যা আমাদের জন্য ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।

সূত্র: দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- SHUMANBD.COM