ডা. কাকলী হালদার: ৪০ বছর বয়সী আকাশ আহমেদ করোনা মহামারির সময় বৃদ্ধ বাবা-মা হারিয়েছেন। সেই সাথে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বন্ধ হওয়ায় হয়েছিলেন চাকরিহারা। বউ বাচ্চা নিয়ে ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এতদিনে অনেক সংগ্রামের পরে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু চীনে নতুন এক ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তাকে আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই বিভীষিকাময় অতীত! আবারও অজানা আতঙ্কে কাটছে দিন। সেই সময়ের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায় ভীত আকাশ আহমেদের মতো আরও অনেকে!
পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া সেই কোভিড ১৯-এর আতঙ্ক এখনো আমাদের পিছু ছাড়েনি। মাঝে দুই বছরের বিরতির পরে আবারও এক নতুন আতঙ্কের ছায়া! অতীতের দুঃস্বপ্ন সেই লকডাউনের আশঙ্কায় চিন্তিত সারা বিশ্বের মানুষ। কারণ কোভিড-১৯ মহামারির পরে, চীন আবারও একটি নতুন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সম্মুখীন হয়েছে। এইবারের ভাইরাসটি হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) যা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ সৃষ্টি করে। এই প্রাদুর্ভাব চীনের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং হাসপাতালগুলোয় রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ৬ জানুয়ারি ২০২৫ আট মাসের এবং তিন মাসের দুই শিশুর শরীরে এই ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তাই এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়েও কোভিডের মতো ক্রমশ বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। তবে কোভিড-১৯ অন্য ধরনের ভাইরাস ছিল।
হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) প্যারামিক্সোভিরিডি ফ্যামিলির অন্তর্গত একটি ভাইরাস। সাধারণত উপরের শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণ করে সাধারণ সর্দি-কাশির মতো লক্ষণ সৃষ্টি করে। তবে, শিশু, বৃদ্ধ এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন (ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, লিভার ও কিডনি রোগ, হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, এইডস ইত্যাদি) ব্যক্তিদের মধ্যে এটি শ্বাসযন্ত্রের নিচের দিকে সংক্রমিত হয়ে ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি বা নিউমোনিয়ার মতো গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে।
এই ভাইরাসটি প্রথম নেদারল্যান্ডে ২০০১ সালে শনাক্ত হয়। সাধারণত শীতকালে বায়ুদূষণ বা বাতাসের ধরন পরিবর্তন হওয়ার কারণেই এদের প্রকোপ বাড়ে।
এই ভাইরাসটি প্রথম নেদারল্যান্ডে ২০০১ সালে শনাক্ত হয়। সাধারণত শীতকালে বায়ুদূষণ বা বাতাসের ধরন পরিবর্তন হওয়ার কারণেই এদের প্রকোপ বাড়ে। কখনো কখনো শরৎকালেও প্রকট হতে পারে। রোগ প্রতিরোধ কম সম্পন্ন মানুষের এইচএমপিভি নিউমোনিয়া থেকে অশোধিত মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
চীনে ২০২৪ এর শেষের দিকে শুরু হলেও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এইচএমপিভির প্রাদুর্ভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও এবং ছবিতে চীনের হাসপাতালগুলোর ভিড় দেখা গেছে, যেখানে রোগীরা চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছেন।
বিশেষ করে শিশুদের হাসপাতালে এই ভিড় বেশি দেখা যাচ্ছে। চীনে ১৪ বছরের নিচের শিশুদের মধ্যে এইচএমপিভির হার বাড়ছে। বিশেষত স্কুলে বা হোস্টেলের মতো জায়গায় বাচ্চারা একসঙ্গে থাকার জন্য এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যদিও চীন জানিয়েছে, এটা সিজনাল ফ্লুর প্রকোপ। খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার বা মহামারি ঘোষণার মতো এখনই কিছু ঘটেনি।
তবে সংক্রমণটি একদম নতুন না হলেও, এই ভাইরাসের বিষয়ে প্রাথমিক সচেতনতায় প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ এখন ভাইরাসটির নতুন কোনো মিউটেশন হয়েছে কিনা বা এটি আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়েছে কিনা তা এখনো জানা যায়নি। এসব নিয়ে গবেষণা চলছে।
তবে এই ভাইরাস নতুন না। প্রায় ৫০ বছর ধরে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব মানব সভ্যতায় রয়েছে। আমাদের দেশে আগেও এই ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। দেশে এই ভাইরাস নতুন না।
কোভিডের মতোই সাধারণত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। এছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তি বা তার ব্যবহার করা জিনিসের সংস্পর্শে এলে, কোথাও স্পর্শ করে হাত না ধুয়ে নাকে-মুখে-চোখে হাত দিলে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। সাধারণত সংক্রমণের ৩-৭ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণ দেখা যায়।
সাধারণ ফ্লু’র মতো জ্বর, কাশি, নাক বন্ধ বা সর্দি, মাথাব্যথা, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা বা ক্লান্তি লাগা এইচএমপিভি ভাইরাসের সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ। তবে শিশু, কম রোগ-প্রতিরোধ সম্পন্ন ব্যক্তি এবং বৃদ্ধদের মধ্যে এটি শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়ার মতো গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে।
হালকা উপসর্গগুলো সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয় এবং কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যায়। তবে কোনো কারণে জটিলতা বা গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি হলে তা দীর্ঘদিন থাকতে পারে। শ্বাসকষ্ট, তীব্র জ্বর এবং শরীরে পানিশূন্যতার লক্ষণ যেমন প্রস্রাব কমে যাওয়া দেখলে রোগীকে সাথে সাথে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
এই ভাইরাসটি শনাক্তকরণ পরীক্ষাগুলো আমাদের দেশে এখনো সব জায়গায় করা হয় না। উপসর্গ শুরু হওয়ার ৩-৫ দিনের মধ্যে এইচএমপিভি ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির নাক বা মুখের সোয়াব নিয়ে পরীক্ষা (RT-PCR) করলে এই ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন নমুনা যেমন রক্ত, লালা বা অন্য জৈবিক তরল নিয়েও পরীক্ষা করা যায়। ELISA, Immunofluorescence পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসটির এন্টিজেন বা এন্টিবডি এবং RT-PCR এর মাধ্যমে জিন শনাক্তকরণ করা হয়।
এইচএমপিভির জন্য বর্তমানে কোনো টিকা নেই এবং চিকিৎসা সাধারণত লক্ষণভিত্তিক করা হয়। ওষুধ লক্ষণগুলো উপশম করার জন্য ব্যাবহার করা হয়। যেমন জ্বর কমানোর জন্য ওষুধ, ব্যথা উপশম করার জন্য ওষুধ। তবে এর পাশাপাশি বেশি পরিমাণে তরল পান করা, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার এবং পরিমিত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি।
কোভিডের মতোই সাধারণত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। এছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তি বা তার ব্যবহার করা জিনিসের সংস্পর্শে এলে, কোথাও স্পর্শ করে হাত না ধুয়ে নাকে-মুখে-চোখে হাত দিলে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।
খাবারের আগে ও পরে, বাইরে থেকে ঘরে প্রবেশের সময় হাত-পা ও মুখ নিয়মিত সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে হাত ধোয়া, ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার করা, হাত না ধুয়ে নাকে-চোখে-মুখে হাত না দেওয়া, অসুস্থ ব্যক্তিদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা, ভিড়যুক্ত স্থান এড়ানো, এই সময়ে অসুস্থ হলে ঘরের বাইরে না যাওয়া, হাঁচি-কাশির সময় রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়া এইচএমপিভি ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের অন্যতম স্বাস্থ্যবিধি।
ব্যবহৃত টিস্যুগুলো সঙ্গে সঙ্গেই ময়লারবিনে ফেলে দিতে হবে এবং বিনে ঢাকনা দিয়ে রাখতে হবে। বিন ভরে যাওয়ার আগেই তা বাইরের ডাস্টবিনে ফেলে আসতে হবে।
চীনে এইচএমপিভির প্রাদুর্ভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যদিও এটি সাধারণত মৃদু লক্ষণ সৃষ্টি করে, তবে কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে। এখন পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি ফলে প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য সঠিক তথ্য, সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ডা. কাকলী হালদার: সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ