মঙ্গলবার | ৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঢাকা-দিল্লীর সম্পর্কের টানাপোড়েনের শেষ কোথায়?

নিজস্ব প্রতিবেদক: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বড় ছাপ পড়েছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। দেশব্যাপী সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়ে শেখ হাসিনা একটি সামরিক বিমানে চড়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। তিনি যখন প্রাথমিকভাবে নয়াদিল্লির বাইরে হিন্দন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেন, তখন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তাকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলেন। এখন শেখ হাসিনা যদি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চান, দেশটির সরকার সম্ভবত তাকে সেই আশ্রয় দেবে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে।

শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের কয়েক সপ্তাহ পরও বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তুঙ্গে রয়েছে। সব কিছুতেই দৃশ্যমান হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ক্রমবর্ধমান আহ্বান থেকে শুরু করে নয়াদিল্লি ভিসা ও পানি ব্যবহার করে বাংলাদেশকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে এমন অভিযোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি ক্ষোভ বাড়ছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় দলের ও ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। বড় প্রতিবেশী হওয়ায় সম্পর্কের চলতি টানাপড়েন বাংলাদেশের দিক থেকেও গুরুত্বের সঙ্গে মনোযোগ পাচ্ছে। আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। দ্বিপক্ষীয় এ সম্পর্ককে জনকেন্দ্রিক করতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একক বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হবে। তবে তারা মনে করেন, ভারতকেও বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগী হতে হবে।

ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবি জোরালো হচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ ও বিচার করতে হবে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও এ দাবির প্রতিধ্বনি করেন। সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছে সরকার। ফলে শেখ হাসিনা বৈধভাবে কত দিন ভারতে থাকতে পারবেন, তা স্পষ্ট নয়। ভারত সরকারও এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।

সম্প্রতি দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করা হয়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী নদীর উজানে অবস্থিত ডুম্বুর বাঁধ ইচ্ছাকৃতভাবে খুলে দেওয়ার কারণে এই বন্যা হয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশের মানুষ। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন এক বিবৃতিতে জানায়, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বাঁধের ভাটিতে বড় বড় জলাবদ্ধতার পানি থেকে এই বন্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ড. ইউনূসকে বলেছিলেন পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বাঁধের পানি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছেড়ে যায়। তবে বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, অতীতের মতো ভারত তার প্রতিবেশী দেশকে পানি ছাড়ার বিষয়ে সতর্কতা জারি করেনি। এ সতর্কবার্তা মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে সহায়ক হতে পারত।

এ ছাড়া শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতের তরফ থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে বলে অনবরত দাবি তোলা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথাও বলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে সংখ্যালঘুদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদানে আশস্ত করেছিলেন। সেই সময় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ভারতীয় মিডিয়ার প্রচারকে মিথ্যা বলেও মন্তব্য করেছিল সরকার। দুই দেশের সম্পর্কে সীমান্ত হত্যা বার বার আলোচনায় উঠে এসেছে। বর্তমানেও সীমান্ত হত্যা দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি করেছে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, সীমান্তে একটি মানুষ গুলি খেয়ে মারা গেলে সারা দেশে এর প্রতিক্রিয়া হয় এবং সেটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, যা আমরা চাই না। সীমান্ত হত্যা দুই দেশের ভালো সম্পর্কের পথে অন্তরায়। দুই দেশের মধ্যে আমরা অবশ্যই ভালো সম্পর্ক চাই। আমরা সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক চাই।

ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও। তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক দরকার। কিন্তু সেই সম্পর্ক হবে ন্যায্যাতা এবং সমতার ভিত্তিতে। তিনি প্রতিবেশীর সঙ্গে পারস্পরিক সমান সম্মান এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, সরকার পরিবর্তন-পরবর্তী সময়ে ভারত আমাদের জনগণের চাহিদা ও প্রত্যাশাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তারা এটিকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে।

হুমায়ুন কবির বলেন, আমি বলব পারস্পরিক বোঝাপড়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। যার কারণে দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা উদ্বেগ তৈরি করেছে। তবে আশা করি, প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে যাবেন, সেখানে যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়, তিনি বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হবেন এবং তাতে করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার ইতিবাচক সম্ভাবনা বাড়বে।
###

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- Payra Team