মঙ্গলবার | ৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যারা এই নির্দোষ মানুষটিকে হত্যা করলো তারা কি একবারও বাচ্চাটার কথা ভাবেনি?

নিজস্ব প্রতিবেদক: দশ বছর আগে ডান পা হারানো আব্দুল্লাহ আল মাসুদের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেলের লাশ কাটা ঘরে মেঝেতে রাখা। লাল কালো স্ট্রাইপ চাদরে মোড়ানো পুরো শরীর শুধু মাথাটা বের হয়ে আছে। পাশেই কাটা ডান পায়ে লাগিয়ে চলার প্লাস্টিকের পা এবং জুতোগুলো রাখা। মর্গের একজন শরীর থেকে চাদরটা সরাতেই বাম পা বেরিয়ে এলো, তালুতে কিছু একটা দিয়ে গভীর ক্ষত। ছেঁড়া মলিন জিন্স প্যান্ট, শরীরের ওপরের অংশ খোলা। হাত দুটোতে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। অনুমান করা যায় ভেঙে গেছে হয়তো। পুরো ঘরজুড়ে মোট ৫টি মরদেহ রাখা। ময়নাতদন্তের জন্য সিরিয়ালে মাসুদ ছিল তিন নম্বরে।

মর্গ থেকে বের হতেই প্রধান ফটকের বাম পাশে বেঞ্চে বসা এক নারী। দেখেই বোঝা যায় বিধ্বস্ত, বিমর্ষ। পাশেই আরেক সমবয়সী নারীর কোলে এক নবজাতক। কথা বলতেই এগিয়ে গেলে বিমর্ষ সেই নারী বাচ্চাটিকে নিজের কোলে তুলে নিলেন। নারীটি তার নাম বিউটি আরা বলে জানালেন। বয়স প্রায় ২৪। আর কোলে ফুটফুটে শিশুটি মাত্র ৬ দিনের একটি কন্যাশিশু।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) মেডিকেল সেন্টারের স্টোর অফিসার ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মাসুদের স্ত্রী বিউটি আরা জানালেন দুই পরিবারের অমতে তাদের বিয়ে হয়েছে ২০২৩ সালের ৮ মার্চ। এখনও কোনো পরিবারের পক্ষ থেকে মেনে নেওয়ার বিষয়ে কোনো সাড়া পাননি তারা। আলাপের শুরুতেই কান্না ভেজা কণ্ঠে বিউটি বললেন, কি হবে এই শিশুটির? কি হবে তার? কে দায়িত্ব নেবে এখন?

শনিবার কিভাবে মাসুদের এমন ঘটনা ঘটলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাচ্চাটিকে ২ দিন হয় হাসপাতাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কোয়াটার জুবেরি ভবনে নিয়ে উঠেছি। তখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে, সন্তান প্রস্রাব করছে না এমন সমস্যায় চিকিৎসকের দেওয়া একটি ওষুধ কিনতে বের হলো মাসুদ। সাড়ে সাতটায় ফোন করলাম, বললো বিনোদপুরে চা খেয়ে আসছি। পরে ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তাকে আর পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে রাত সাড়ে দশটার দিকে শুভ নামের একজন ফোন করে বলেন যে মাসুদকে মেরে থানায় নেয়া হয়েছে। আমি তো বাসায় একা, সেই সময় আপনজন কাছে কেউ নেই। কাজ করে দেয় যে খালা তাকে ফোন করে ডেকেছি, তিনি এসে আমার আর বাচ্চার সঙ্গে ছিলেন। গভীর রাতে হাসপাতাল থেকে কেউ একজন ফোন করে জানায় যে মাসুদ মারা গেছে। এরপর থেকে পুরো পৃথিবী উল্টে পাল্টে গেছে।

আপনাদের সংসার জীবন কেমন ছিলো? এমন প্রশ্নে বিউটি বলেন, ‘পড়াশোনা তেমন করিনি, সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। মাসুদ দীর্ঘ দিন চাকরি খুঁজছিল, কিন্তু কেউ দেয়নি। আমাদের প্রেমের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের ছিল কিন্তু ওর চাকরি না থাকায় বিয়েটা হচ্ছিল না। বাসায় এ নিয়ে বনিবনাও হচ্ছিল না। অবশেষে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চাকরি পায় মাসুদ। শুরুতে ব্যাংকে চাকরি হবার কথা ছিল, কিন্তু একটানা বসে অসুস্থ শরীরে চাকরি করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিটা নেয়। চাকরি পাবার পরপরই বিয়েটা করি। কিন্তু টাকা পয়সা তেমন নেই। বেতন খুব একটা বেশি না। যা ইনকাম করে তাই খেয়ে পরে শেষ। এই যে আমার ডেলিভারির টাকাটাও খালার কাছ থেকে ২৫ হাজার ধার দেনা করে নিতে হয়েছে। এ মাসের মাইনে এখনও পাইনি। ভিসি ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ে, বেতন হয়নি। এই যে এতদূর হাসপাতাল এলাম, হাতে দশটা টাকাও নেই’। বলতে বলতে চোখ ভিজে পানি পড়তে লাগলো বিউটির।

বাচ্চাটা হবার পর কেমন আদর করতো মাসুদ, এই প্রশ্ন শুনেই বিউটি কান্নায় ভেঙে পড়লো। বলেন, ‘বাইরে যাবার আগে পর্যন্ত কত কথা বাচ্চার সঙ্গে। কিন্তু আমার বাচ্চাটা এখন কাকে বাবা বলবে? আমার এ দুর্দিনে কে আমাদের দুজনের দায়িত্ব নেবে? যারা এই নির্দোষ মানুষটিকে হত্যা করলো তারা কি একবারও বাচ্চাটার কথা ভাবেনি? নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে শিশুটির নাম রাখতে চেয়েছিল মাসুমা। ১৫ দিনের মধ্যে আকিকা দিতে চেয়েছিল মাসুদ। একজন পাওনাদারের কাছ থেকে টাকা পাবার কথা, সেটা দিয়ে আকিকা দিতে চেয়েছিল মাসুদ’।

বিচার চান কি না? এমন প্রশ্নে বিউটি একেবারেই নিশ্চুপ! শুধু চোখ বেয়ে পানি ঝরলো অঝোরে। হয়তো চায় আবার হয়তো চায় না। বিউটির ভাষ্য, মাসুদ ১০ বছর আগে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে রাজনীতিতে কোনোভাবেই সক্রিয় ছিল না। আর ৫ আগস্ট পর্যন্ত সে বাসাতেই ছিল। যে মানুষটা নিজে হেঁটে চলে বেড়াতে পারতো না, সেই মানুষ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাবে কি করে?

একে

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- Payra Team