রবিবার | ১৬ মার্চ, ২০২৫ | ২ চৈত্র, ১৪৩১

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার: কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট !

দুলাল আহমদ চৌধুরী : প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তাঁরা সংস্কার চান। সংস্কারের মাধ্যমে জাতি হিসেবে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে চান। এই সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তিনি ছয়টি কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছয়টি কমিশনের প্রধানদের নামও ঘোষণা করেন। তাঁরা হলেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান শাহদীন মালিক, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন (সাবেক স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন সচিব) এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।

বদিউল আলম মজুমদারের বিরুদ্ধে সাবেক সিইসির দুর্নীতির অভিযোগ: ২৭ জানুয়ারী ২০২২ তারিখে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদা ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুললেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। তিনি অভিযোগ করেন, বদিউল আলমকে ড. হুদা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচনি কাজ দিয়েছিলেন। আর ওই কাজে লাখ লাখ টাকা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক বৈঠকে তিনি এ অভিযোগ করেন।

তিনি বদিউল আলম মজুমদারকে নিয়োগ দিয়েছেন কিসের ভিত্তিতে? সেখানে কী কোনও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, কোনও যোগ্যতার ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছিল? তাহলে লাখ লাখ টাকা তাকে কিভাবে দিলেন! লাখ লাখ টাকার অভিযোগ আছে, সেটা আমাদের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই লোক যেন এখানে না আসতে পারে। এর বিরুদ্ধে আর্থিক অনেক অনিয়ম আছে।

বদিউল আলম মজুমদারের উদ্দেশ করে কে এম নূরুল হুদা বলেন, আমি যখন কুমিল্লার ডিসি ছিলাম, তখন থেকে তার সঙ্গে পরিচয়। সেই সুবাদে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই দেখা করতে চাইলেন। বললাম, আমি তো এখন ব্যস্ত। এরপর টেলিফোনে, বাসায়, এখানে-ওখানে সার্বক্ষণিক বলেন, আপনার সঙ্গে দেখা করবো। একদিন একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে দেখা করলাম। তিনি হাফিজ সাহেব, আলিম সাহেবসহ ১০-১৫ জন লোক নিয়ে আসলেন। একটা বড় বই দেখিয়ে বললেন, এই কাজটা আমরা করেছি। বললেন, প্রার্থীদের হলফনামা সংগ্রহ করে আমরা ছাপিয়েছি। বারবার বলেন, আমি শামসুল হুদা কমিশনের সময় কাজ করেছি। উনারা যাবার পর কর্মকর্তারা জানালেন, উনার বিরুদ্ধে প্রায় ১ কোটি টাকা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আছে। কাজ না করেই টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে। তারপরে কমিশন সভায় তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আছে। এরপর আমি সাবধান হয়ে গেলাম। এরপর তিনি ছাড়েন না, বারবার টেলিফোন করেন, সাক্ষাৎ করতে চান। বারবার বলেন, ড. শামসুল হুদা কমিশনের সময় প্রচুর কাজ করেছি।… এরমধ্যে গেলাম শ্রীলংকায়, কলম্বোয়। সেখানে তারাও গেছেন। ওখানেও বারবার একই কথা বলেছেন। আমি বললাম এই কাজ (হলফনামা বই আকারে প্রকাশ) করা কী দরকার? এটা তো কোনও কাজ হইল না। কতগুলা কাগজ এখানে (কমিশনে) থাকে, আপনারা ছাপিয়ে দিলেন। এটা তো ওয়েবসাইটে আছে। এটা নিয়ে বই করার তো কিছু দেখতেছি না। আমি তো মনে করি ঝালমুড়ির ঠোঙা বানানো ছাড়া এটার কোনও কাজ নাই।

তারপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম—কী ক্যাপাসিটিতে, কিভাবে কাজ পেয়েছিলেন, কোনও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল? তিনি বললেন, না। আমরা তো এমনিই কাজ পেয়েছিলাম। সে সময় আমি তাকে বললাম, আপনি তো নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি নন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ নন, তাহলে কোন যোগ্যতায় নেবো আপনাকে। একটা বই তৈরি করবেন এজন্য তো আপনাকে নেওয়ার প্রয়োজন নাই। আমি তো মনে করি না নির্বাচন কমিশনের কোনও প্রয়োজন আছে আপনার সার্ভিস নেওয়া। এভাবে দু’বছর তিনি আমার পেছনে ঘুরঘুর করেছেন।

সুজনের প্রতিবাদ: সিইসি নুরুল হুদার অভিযোগের পর সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সিইসি নূরুল হুদার মিথ্যাচারে আমরা স্থম্ভিত। ২৯ জানুয়ারী এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান লিখিত বক্তব্যে বলেন, কে এম নুরুল হুদা সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের বিরুদ্ধে ১ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগসহ কিছু কুরুচিপূর্ণ, অশালীন, অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন। এতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ড. বদিউল আলম মজুমদারের ব্যক্তিগত আর্থিক লেনদেনের কোনো সম্পর্ক নেই এবং কোনোদিন ছিলও না। তিনি কমিশন থেকে কখনো কোনো কাজ নেননি, অসমাপ্ত রাখার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

একই বক্তব্যে তিনি ফের বলেন, ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় হলফনামায় বর্ণিত প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশ ও ভোটারদের মধ্যে বিতরণ, পোস্টারিং এবং প্রার্থী-ভোটার মুখোমুখি অনুষ্ঠানের আয়োজনের কাজটি করার জন্য ড. শামসুল হুদা কমিশন ইউএনডিপির অর্থায়নে পরিচালিত এসইএমবি প্রকল্প থেকে সুজনকে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৬০০ টাকা দিয়েছিলেন। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় একই ধরনের কাজের জন্য সুজনকে ৩ লাখ দেয়। অর্থাৎ দুটি নির্বাচনে সর্বমোট ১২ লাখ ৫০ হাজার ৬০০ টাকা সুজন নির্বাচন কমিশন থেকে পায়। নির্বাচন দুটির জন্য নির্ধারিত কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করে যথাসময়ে কমিশনের কাছে বিল-ভাউচারসহ হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট: সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রধান উপদেষ্ট ছয়টি কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে বদিউল আলম মজুমদারকে।

নির্বাচন কমিশন সংস্কার পরবর্ত্তী নির্বাচনের জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পরপর ৩টি জাতীয় নির্বাচনে দেশের মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের ভয়াবহ পতনের পর অন্তর্বর্ত্তীকালীন সরকার তথা সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি জনগণের গভীর আস্থা ও উচ্চাকাঙ্খা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কোনোভাবে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিংবা বিতর্কিত কোনো ব্যক্তিকে সাংবিধানিক অতি গুরুত্বপূর্ন এই প্রতিষ্ঠানের সংস্কার কমিশন প্রধান করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হয়েছে, তা ভাববার বিষয়। কারণ এমন সিদ্ধান্ত পতিত সরকারের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

আমি বিশ্বাস করি, তৎকালীন সিইসি বাড়িয়ে অভিযোগ করেছেন। সুজনও অভিযোগ মিথ্যাচার বলে দাবি করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আর্থিক সংশ্লিষ্ঠতার বা অর্থের বিনিময়ে কাজ করার বিষয়টি অস্বীকার করেননি বদিউল আলম মজুমদার। বেলার নির্বাহী পরিচালক, বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান সেসময় সুজনের হয়ে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অর্থের বিনিময়ে কমিশনের কাজ করার বর্ণনা দিয়েছেন। আর এই সুবিধা সুজন পেয়েছিলো ড. শামসুল হুদা কমিশন থেকে। সেটা ১২ লাখ হোক আর কোটি টাকা হোক। বিধায় নুরুল হুদার অভিযোগ এবং সুজনের স্বীকার-অস্বীকার অর্ধসত্য হলেও বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। বদিউল আলম মজুমদার একজন সম্মানিত, সুশিল ও করিৎকর্মা ব্যক্তি। তার সঙ্গে বর্তমান সরকারের প্রায় সকল উপদেষ্টার সুসম্পর্ক রয়েছে। জাতির প্রয়োজনে তাকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন মনে করছেন আপনারা, তা ঠিক আছে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক বা সমালোচনা রয়েছে, সেখানে সংস্কারের দায়িত্ব না দিয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাকে দায়িত্ব দিতে পারতেন। বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার এখনও বিবেচনার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

© 2024 payranews.com | About us | Privacy Policy | Terms & Condidtion
Developed by- SHUMANBD.COM