পায়রা নিউজ ডেস্ক: রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সাকল্যে দেড় বছরের মতো গৃহবন্দী ও কারান্তরীণ ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কারা ও গৃহবন্দী অবস্থায় কাটিয়েছেন প্রায় সাড়ে ছয় বছর। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ব্যাপক অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। স্বৈরশাসকের তকমা নিয়ে তিনি আশ্রয় নেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পরদিনই রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়ার শাস্তি মওকুফ ও মুক্তির ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দুই নেত্রীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাড়ে ছয় বছর জেল খাটলেও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে জয়ী খালেদা জিয়াই। অন্যদিকে মাত্র দেড় বছর জেল খেটে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যাওয়ায় তিনি রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি পরাস্ত। শেখ হাসিনা শুধু পরাজিতই হননি, আওয়ামী লীগ ও দলের নেতাকর্মীদেরও চরম বিপদে ফেলেছেন। তিনি পালিয়ে না গিয়ে জেলে ঢুকলে বরং তার নিজের ও দলের জন্য মঙ্গল হতো।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সেই সঙ্গে একে একে আটক হতে থাকেন প্রধান দুই দলের নেতাকর্মীরা। এ তালিকা থেকে বাদ যাননি দুই দলের নেত্রীরাও। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে অন্তরীণ করা হয় সংসদ ভবনের কাছে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে। এর প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। অস্থায়ী জামিনে ১১ জুন তাকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অনুমতি দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরপর তৎকালীন সরকার ৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকেও আটক করে। সংসদ ভবনের পাশে আরেকটি কারাগারে অন্তরীণ করা হয় তাকে। সেই সঙ্গে কারাগারে আটক করা হয় খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে। এ সময় গুঞ্জন উঠেছিল, দুই ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন খালেদা জিয়া। কিন্তু খালেদা জিয়া সে সময় কারাবন্দি জীবনকেই বেছে নিয়েছিলেন। এক বছরেরও বেশি সময় পর সর্বোচ্চ বিচারালয়ের নির্দেশে কারামুক্তি ঘটে খালেদা জিয়ার।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি বা চাঁদাবাজির ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা চারদলীয় জোট সরকারের আমলেও নয়টি দুর্নীতির মামলা করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কিত নয়টি মামলা হাইকোর্ট থেকে বাতিল বা খারিজ হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কিত চার মামলায় বাদীরা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের মামলা প্রত্যাহার করে নেন।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে দুই মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে তার সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজা প্রদান করা হয়। প্রথমে তাকে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। পরে ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। সে সময় তার স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতির কথা উল্লেখ করে পরিবারের পক্ষ থেকে কয়েকবার জামিন চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই নাকচ করে দেওয়া হয়। দুই বছর এক মাস সাজা ভোগের পর ২০২০ সালের মার্চে শর্তযুক্ত মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এ সময়ে তাকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ ও বিদেশ যেতে না পারার শর্ত দেওয়া হয়। এরপর থেকে প্রতি ছয় মাস অন্তর আবেদনের পর এ শর্তযুক্ত মুক্তির মেয়াদ বাড়ায় সরকার। অবশেষে ৬ আগস্ট পুরোপুরি মুক্তি পান খালেদা জিয়া।
দলের প্রধানের মুক্তিতে ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপির কর্মীদের মধ্যে এখন বেশ চাঙা ভাব। খালেদা জিয়ার মুক্তির পরদিন ৭ আগস্টই এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। জেলমুক্ত খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে এখন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে দলটি। দীর্ঘদিন আটক থাকা নেতাকর্মীরা ছাড়া পেয়ে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় হয়েছেন।
অন্যদিকে আকস্মিক ক্ষমতাচ্যুতি ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগে আওয়ামী লীগ এখন একপ্রকার বিপর্যস্ত। শেখ হাসিনা দেশে নেই। দলের কেন্দ্রীয় ও সিনিয়র নেতারাও আত্মগোপনে। পুরোপুরি নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় রাজনীতির ময়দানে সংগঠিত হতে পারছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতেও দলটির নেতাকর্মীদের তেমন কোনো কর্মসূচির আয়োজন করতে দেখা যায়নি। দলটির কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকেও সেখানে উপস্থিত হতে দেখা যায়নি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে কিছু মানুষ জড়ো হলেও সেখানে আগে থেকে উপস্থিত অনেকের বাধার মুখে তারাও শোক জানাতে পারেননি। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ এখন একপ্রকার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সিদ্ধান্তটি ছিল একপ্রকার রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। দেশে থেকে গিয়ে তিনি যদি কারাবরণও করতেন, তাকে মুক্তির দাবি তুলে আওয়ামী লীগের মাঠে নামার সুযোগ ছিল। দলের নেতাকর্মীদের কাছেও বার্তা যেত যে কঠিন পরিস্থিতিতেও তাদের ত্যাগ করেননি তিনি। কিন্তু তার দেশত্যাগের সিদ্ধান্তে তারা এখন পুরোপুরি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদেরও বড় অংশের আস্থা হারিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের অস্তিত্বের সংকট সামনের দিনগুলোতে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রাজনীতিতে দলটির প্রত্যাবর্তনকে আরও কঠিন করে তুলবে শেখ হাসিনার নামের সঙ্গে যুক্ত হওয়া স্বৈরশাসকের তকমা।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘খালেদা জিয়া সব সময়ই দেশে থেকে রাজনীতি করে গেছেন। তিনি দলকে ছেড়ে কখনো যাননি। এর ফলে দলের নেতাকর্মীরা সব সময়ই চাঙা থেকেছেন, সচল থেকেছেন। এক-এগারোয় খালেদা জিয়াকে বারবার চলে যেতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি যাননি। তিনি কোনো সংকটেই দেশ ছেড়ে চলে যাননি। এর ফলে আমাদের নেতাদের মনোভাব বরাবরই চাঙা ছিল। এমনকি তিনি যখন লন্ডনে ওনার চিকিৎসার জন্য গেলেন, তখন তিনি বললেন আমার মামলার তারিখ আছে, আমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। তিনি কিন্তু দেশে এসে মামলার মুখোমুখি হয়ে জেলে গেছেন। এ ছাড়া এক-এগারোয় শেখ হাসিনাকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন খালেদা জিয়াই প্রথম বিবৃতি দিয়েছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু শেখ হাসিনা সব সময়ই দেশ ছেড়ে গেছেন। এক-এগারোর সময় কানের চিকিৎসার কথা বলে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। পরে তাকে আর ধরা হবে না-সরকারের এমন প্রতিশ্রুতির পর তিনি দেশে এসেছেন।’ ঠিকানার সৌজন্যে প্রকাশিত