রবিবার | ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানবিক আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গারা অপরাধে জড়াচ্ছে, কী পদক্ষেপ নিচ্ছে প্রশাসন?

ডেস্ক রিপোর্ট, কক্সবাজার: মানবপাচার, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি— এমন কোনও অপরাধ নেই যার সঙ্গে জড়িত নেই বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গারা। দিনে দিনে বাড়ছে এসব অপরাধ। প্রায় প্রতিদিনই হত্যা ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। এ নিয়ে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো রয়েছে বিপাকে। অন্যদিকে অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে স্থায়ী বসতবাড়ি করারও চেষ্টা করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কড়া নজরদারির কারণে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে স্থায়ী বসতবাড়ি করার সুযোগ পায়নি বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। এসব অপরাধ বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নানান উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নো ম্যান্সল্যান্ডসহ আশপাশের এলাকায় নজরদারি বাড়াতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে জাতীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা নিয়ন্ত্রণ নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে ওই বৈঠকে।

বৈঠকে পুলিশ সদর দফতর থেকে দেওয়া প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) জনবল কাঠামো বাড়ানোর বিষয়টি জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত শেষ করতে হবে। একই প্রস্তাবনায় ভাসানচরে ১৭ এপিবিএন গঠন ও পরিচালনার জন্য ৮৫০টি পদ সৃষ্টির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে পুলিশ সদর দফতর। এছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দায়িত্বরত ১৪ ও ১৬ ব্যাটালিয়নের কাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যাতে ক্যাম্পের ভেতরে কোনও অপতৎপরতা চালাতে না পারে সেজন্য এপিবিএন-এর টহল, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো এবং নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এপিবিএন ছাড়াও কক্সবাজার ও নোয়াখালীর পুলিশ সুপার ও চট্টগ্রাম রেঞ্জকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত মাঝিদের (রোহিঙ্গা নেতা) নিরাপত্তায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তাদের ভাষায় ক্যাম্প ও ব্লক ভিত্তিক নেতৃত্বে থাকা রোহিঙ্গা নেতাদের ‘মাঝি’ বলা হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যে মাঝিদের নিরাপত্তায় এপিবিএন ও জেলা পুলিশের সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বাড়ানো হয়েছে বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারি।

পুলিশ সদর দফতরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ঘুমধুম সীমান্তবর্তী কোনাপাড়া এলাকার নো ম্যান্সল্যান্ডে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী বসবাস ছিল। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর গোলাগুলিতে অনেক রোহিঙ্গা পরিবারই অন্যত্র চলে যায়। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রতিপক্ষের বসবাসের ঘরে আগুন দিয়ে ঘুমধুম চলে যায়। সেজন্য ওই এলাকার আশেপাশে যাতে কেউ স্থায়ীভাবে বসতবাড়ি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। বর্তমানে শূন্য রেখায় কোনও রোহিঙ্গা নেই। কোনাপাড়া ক্যাম্পের নো ম্যান্সল্যান্ডে কোনও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যাতে অপতৎপরতা চালাতে না পারে সেদিকেও নজরদারি বাড়াতে হবে।

কোনাপাড়া ক্যাম্পে থাকা প্রায় চার হাজার রোহিঙ্গা নাগরিককে দ্রুত সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। কোনাপাড়া ক্যাম্প সম্পর্কে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, এ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে সুবিধার চেয়ে অসুবিধা বেশি হচ্ছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নির্বিঘ্ন অবস্থানের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, নতুন করে মিয়ানমারের নাগরিক বা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে টহল বাড়াতে হবে। এজন্য কক্সবাজার, বান্দরবান ও মিয়ানমার সীমান্তের বিজিবির আউট পোস্ট ও বিওপি-তে জনবল বাড়াতে হবে।

রোহিঙ্গাদের জন্য নেওয়া প্রকল্পগুলোর মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এনজিও বিষয়ক ব্যুরো রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন এনজিওকে গত ২২ জুন দেওয়া চিঠিতে বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের জন্য নেওয়া প্রকল্পের (এফডিএ-৭) মেয়াদ ছয় মাসের পরিবর্তে এক বছর বাড়ানো হয়েছে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনাপাড়া সংলগ্ন তমব্রু সীমান্তে ছয় কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী ও টহলের জন্য রাস্তা তৈরির কাজ শেষ করেছে। ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজরদারির জন্য ৮৫ ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে দিয়েছে। একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করেছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় (আরআরআরসি)। এছাড়াও ৩০টি চেকপোস্ট, নিরাপত্তা বেষ্টনী, ওয়াকওয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ। ৩৩২টি সিসি ক্যামেরা বুঝিয়ে দিয়েছে।

টেকনাফের আলীখালি আশ্রয়শিবির থেকে গত ৩ জুন ৫ জন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে সন্ত্রাসীরা। পরদিন ৪ জুন একজনের হাতের কবজি কেটে বাকিদের জন্য ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। দুদিন পর ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসে চার রোহিঙ্গা। একদিন পর (৫ জুন) উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে  এক মাদ্রাসা ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ৯ জুন উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে আড্ডা দেওয়ার সময় এক রোহিঙ্গা যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৩ জুন উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে সশস্ত্র দুই গোষ্ঠীর গোলাগুলিতে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন।  ১৬ জুন ভাসানচরে রোহিঙ্গা কিশোরকে গলা ও হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা অন্য দুই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। ১৮ জুন উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে গুলি করে রোহিঙ্গা নেতাকে (মাঝি) হত্যা করা হয়। পরদিন ১৯ জুন আবারও উখিয়া শিবিরে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে রোহিঙ্গা কিশোর নিহত হয়। বান্দরবানে এক বাঙালি কিশোরীকে ধর্ষণ করে এক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী।  ২৬ জুন উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে হাত-পা বেঁধে রোহিঙ্গা তরুণকে ‘গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৬ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. হাসান বারী নূর  বলেন, ১৬ ব্যাটালিয়নের প্রত্যেকটা ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে পাহাড়। সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায়। যে কারণে পাহাড় ঘেঁষে আমাদের যেসব চেকপোস্ট আছে সেগুলোতে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের অবস্থান শনাক্ত ও গতিবিধি নজরদারির জন্য ড্রোনও ব্যবহার করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতে চায়। যে কারণে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাই তৎপর রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু অপরাধে জড়ালে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আরসা এবং আরাকান আর্মি বা কোনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যেনও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকতে না পারে, সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারেও অভিযান অব্যাহত থাকবে।

জামাল উদ্দিনের রিপোর্ট থেকে সংক্ষেপিত।

© 2022 payranews.com
Developed by- Payra Team