রবিবার | ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আওয়ামী লীগের সংস্কারপন্থীরা কে কোথায়?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা অফিস:ওয়ান-ইলেভেন ছিল বিরাজনীতিকরণের এক প্রক্রিয়া। সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি শাসন করতে চেয়েছিল। আর এই ওয়ান-ইলেভেন সরকারের পেছনে দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তারা চেয়েছিল রাজনীতিমুক্ত একটি সরকার গঠন করতে, রাজনীতিবিদদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করতে। আর এই জন্যই রাজনীতিকে বিভক্ত করার এক কূট কৌশলে নেমেছিল ওয়ান-ইলেভেন সরকার। আর এই কৌশলে আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অনেক নেতারাই তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধিতা করেছিলেন। তারা সংস্কারের দাবি করেছিলেন।

 

ওয়ান-ইলেভেনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের জন্য। আর সেই সমস্ত নেতাদেরকে এখনো আওয়ামী লীগে সংস্কারপন্থী নেতা বলা হয়। শুধু আওয়ামী লীগ নয় বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলেই এরকম বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। তার তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগে বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টাটি ফলপ্রসূ হয়নি। আর যারা সেসময় এই সংস্কার করেছিল, বিরাজনীতি প্রক্রিয়াকে বুঝে না বুঝে সহযোগিতা করেছিল তাদের নিয়েই আমাদের এবারের প্রতিবেদন।

 

আমির হোসেন আমু: আমির হোসেন আমু ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই সংস্কার প্রস্তাবে তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতির ক্ষমতা খর্ব করা, দুই মেয়াদের বেশি সভাপতি না থাকাসহ বিভিন্ন রকম প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং সেই সময় তাঁর স্ত্রী অসুস্থ থাকার পরও তিনি দেশে এসে এই সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে সকলকে বিস্মিত করেন। তিন মেয়াদের শেখ হাসিনার সরকারে তিনি মাত্র একবার মন্ত্রি হতে পেরেছিলেন।

 

তোফায়েল আহমেদ: তোফায়েল আহমেদ ছিলেন আরেক সংস্কার প্রস্তাব দানকারী। প্রায় আমির হোসেন আমুর অনুকরণেই এই সংস্কার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। যে কারণেই হোক এই সংস্কার প্রস্তাব ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতিকে মাইনাস করার পক্ষে। পরবর্তীতে তোফায়েল আহমেদ নিজেই স্বীকার করেছেন যে, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপে তিনি এই সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিন মেয়াদের শেখ হাসিনার সরকারে তিনি মাত্র একবার মন্ত্রি হতে পেরেছিলেন।

 

প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক: প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক বিভিন্ন সময়ে শেখ হাসিনা বিরোধী ছিলেন। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন। পরে আবার আওয়ামী লীগের ফিরে এসেছিলেন। ওয়ান ইলেভেনের সময় তিনি শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন। বিকল্প নেতৃত্বের বিকাশের জন্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

 

প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত: প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও চার সংস্কার প্রস্তাব প্রদানকারী আওয়ামী লীগ নেতাদের অন্যতম শিষ্য ছিলেন। তিনি এই সংস্কার প্রস্তাব সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিলেন। যা অন্য তিন নেতার প্রায় অনুরূপ। অল্প সময়ের জন্য তিনি রেল মন্ত্রী হয়েছিলেন। ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন।

 

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ: সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং ওয়ান ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মোহাম্মদ মনসুর শুধু সংস্কারপন্থী ছিলেন না, তিনি গোপনে সেনা সমর্থিত সরকারের বিরাজনীতির প্রক্রিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন এবং তাদেরকে সহযোগিতা করেছিলেন। মইন উ আহমেদ যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন সেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন বলেও বিভিন্ন মহল মনে করেন। পরে আওয়ামী লীগে আর স্থান হয়নি সুলতান মনসুরের। গণফোরাম থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তিনি একাদশ জাতীয় সংসদে এমপি নির্বাচিত হন।

 

মাহমুদুর রহমান মান্না: মাহমুদুর রহমান মান্না সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদের মতো শেখ হাসিনা বিরোধী অবস্থানে চলে যান এবং ওয়ান-ইলেভেন সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী হিসেবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিলেন। এখনো তিনি সরকার বিরোধী তৎপরতার সঙ্গে জড়িত।

 

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ: অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থীদের তাত্ত্বিক গুরু হিসেবে আবির্ভূত হন এবং তার বাড়িতেই সংস্কারপন্থীরা বিভিন্ন বৈঠকে উপস্থিত হতেন বলে জানা যায়।

 

মুকুল বোস: মুকুল বোস ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সংস্কারপন্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনার সমালোচনা করেছিলেন। মুকুল বোস আওয়ামী লীগকে ভাঙনের মুখে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

 

প্রয়াত আ খ ম জাহাঙ্গীর: আ খ ম জাহাঙ্গীর ছিলেন নীরব সংস্কারপন্থী। তিনি শুধু অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এবং মুকুল বোসের কারণে সংস্কারপন্থী হয়েছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। এ কারনে ওয়ান ইলেভেনের পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়নি।

 

সাঈদ খোকন: সাঈদ খোকন শুধু সংস্কারপন্থী ছিলেন না। তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে সেনাসমর্থিত সরকারের কিংস পার্টিতেও যোগদান করেছিলেন। যদিও তিনি পরবর্তীতে সেখান থেকে ফিরে আসেন। এবং ঢাকার মেয়র হন। মেয়র পদে নানা অনিয়মের কারনে দ্বিতীয়বার তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি।

 

আখতারুজ্জামান: ডাকসুর সাবেক ভিপি আখতারুজ্জামানও ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থী ছিলেন এবং সেই সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের পক্ষে মান্না এবং সুলতান মনসুরের সঙ্গে কাজ করেছিলেন বলেও জানা যায়। ওয়ান ইলেভেনের পর তিনটি সংসদ গেলেও একটিও দলীয় মনোনয়ন পাননি তিনি। পরবর্তীতে তাকে গাজীপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক করা হয়।

তবে এই সংস্কারপন্থীরা শেষপর্যন্ত সফল হননি। তারা কোণঠাসা হয়েছেন। কেউ কেউ আবার শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এদের কাউকেই শেখ হাসিনা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমা করেননি। তাদের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ক্ষমা করেছি। কিন্তু ভুলে যাইনি।

© 2022 payranews.com
Developed by- Payra Team