রবিবার | ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কী মধু এলজিইডি’তে? জালিয়াতি করেও প্রধান প্রকৌশলী পদে থাকতে মরিয়া সেখ মোহাম্মদ মহসিন!

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা অফিস: চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে এসে ভুয়া জন্মসনদ নিয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন। তার বায়োডাটার মাধ্যমিকের স্কুল সেকেন্ডারি সার্টিফিকেট, এলজিইডিতে প্রথম যোগদানের এলপিসির সত্যায়িত কপিসহ চার তথ্য চেয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সেখ মোহাম্মদ মহসিনের চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি মাসের ২৭ তারিখ। শুধু তাই নয়, সেখ মোহাম্মদ মহসিনের বিরুদ্ধে চাকরির মেয়াদের শেষ সময়ে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। সেসব তদন্ত করার নির্দেশনাও দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

সেখ মোহাম্মদ মহসিনের বয়স নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী(প্রশাসন) মো. শফিকুর রহমানের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবী করা হয়,  এলজিইডির বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন ১৯৬৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এসএসসি সনদেও তাঁর জন্ম তারিখ একই উল্লেখ আছে। তিনি ১৯৮৮ সালে পিএসসি’র মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে এলজিইবিতে যোগ দেন, যা পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে এসএসসি সনদ ও জন্ম তারিখ নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে জানানো হয়, সম্প্রতি একটি বিশেষ মহল তার এসএসসি সনদের জন্ম তারিখ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে মনগড়া ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালাচ্ছে, যা খুবই দুরভিসন্ধিমূলক। এই অপপ্রচার একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান প্রধান প্রকৌশলীর সম্মানহানি এবং এলজিইডির ভাবমূর্তি খর্ব করেছে। আমরা এই ভিত্তিহীন সংবাদের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।

এদিকে শেখ মোহাম্মদ মহসিনের দায়িত্ব পালনকালে এলজিইডির আইইউজিআইপি, কোভিড ১৯ রেসপন্স, সুপার ব্রিজ, জলবায়ু সহনশীল গ্রামীণ অবকাঠামো প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি চলমান প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি না থাকা ও অনিয়ম-দুর্নীতি ও অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে এডিবি ও বিশ্বব্যাংক অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মো. আব্দুর রহমানের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশল সেখ মোহাম্মদ মহাসিন এর জম্ম তারিখের জটিলতা নিরশনের জন্য নিম্নবর্ণিত তথ্যাদি জরুরি ভিত্তিতে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর যে সব তথ্য চাওয়া হয়েছে, সে গুলো হচ্ছে- সেখ মোহাম্মদ মহসিনের এস.এস.সি সাটিফিকেটের সত্যায়িত ছাড়ালিপি, এলজিইডিতে প্রথম যোগদানের এলপিসির সত্যায়িত কপি, এলজিইডিতে যোগদানের পর প্রথম জ্যেষ্ঠতা তালিকার কপি এবং এলজিইডির প্রকৌশলীদের খসড়া জ্যেষ্ঠতার তালিকা ২০২১ সালের কপি।

সূত্রে জানা গেছে, সেখ মোহাম্মদ মহসিনের ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম জেলায় জম্মগ্রহণ করেন। ২২ জুন ১৯৮৮ সালে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু তিনি ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ সালে জম্ম সনদ দেখিয়ে আরও এক বছর চাকরিতে থাকার পাঁয়তারা করেছেন। ইতোমধ্যে বিষয়টি স্থানীয় সরকার বিভাগ জানতে পেরেছে এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।

তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে প্রধান প্রকৌশলী। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ করা হয়েছে তা সত্য নয়। মন্ত্রণালয়ে চিঠি এখনো পাইনি।

স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো অভিযোগে বলা হয়, অধিদপ্তরের এসব প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক পদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ না দিয়ে জুনিয়র প্রকৌশলীদের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যেখানে প্রধান প্রকৌশলী শেখ মো. মহাসিন সুপারিশ করেছেন। এসব নিয়োগ দিয়ে মোটার অংকের টাকা নিয়েছেন তিনি। সুপার ব্রিজ প্রকল্পে সেলিম মিয়াকে প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করে পরে বিশ্বব্যাংকের আপত্তিতে তিন মাস পর প্র্যতাহার করেছেন। এই প্রকল্পের মেয়াদ ৭ বছরে সম্পূর্ণ হয়েছে অথচ কাজ সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। এই প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এই প্রকল্পের ৯০০ কোটি টাকা গত অর্থ বছরে ফেরত নিয়েছে।

অপর দিকে কোভিড- ১৯ রেসপন্স প্রকল্পের পিডি নিয়োগ করা হয়, বান্দরবানে কর্মরত তৎকালিন নিবার্হী প্রকৌশলী নাজমুল শাহাদাত মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানকে। এই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি গত দু বছরে হয়েছে মাত্র দুই শতাংশ। আড়াই হাজার কোটি টাকার বিশ্ব ব্যাংকের প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল দুই বছর। এই প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে এডিবি রক্ষণে বাস্তবায়িত আইইউজিআইপি প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে গাজীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল বারেককে। সেখানে অভিজ্ঞ এবং জ্যেষ্ঠতাও মানা হয়নি। প্রকল্পের কাজে অনিয়ম অর্থ লোপাটের মতো ঘটনা ঘটেছে। প্রধান প্রকৌশলী শেখ মো. মহামিনের চাকরির মেয়াদ শেষ পর্যায়ে এসে অধিদপ্তরে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের ভবন বানিয়েছেন। এ ছাড়া জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদায়নের ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য করেন প্রধান প্রকৌশলী ও তার নিয়োজিত সহকারীদের।

তার বিরুদ্ধে, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি স্বেচ্ছচারিতার অভিযোগও আছে। প্রধান প্রকৌশলীসহ তার সেন্ডিকেটের লোকজন দিয়ে এলজিইডিকে ২০ বছর পেছনে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ। সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য এলজিইডির বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প/মাস্টাররেলে নিয়জিত প্রায় ৩৮৩২ জন কর্মচারী দীর্ঘ ২৫/৩০ চাকরি করা কর্মচারীদের চাকরি নিয়মিত করণের আদেশ সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন না করে মোটা অংকের ঘুষ-বাণিজ্য করার জন্য নতুনভাবে সার্কুলার দিয়ে কর্মচারী নিয়োগ করছে। এসব অপকর্মের সহযোগী হিসেবে প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিনকে সহযোগিতা করছেন তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শফিকুর রহমান (প্রশাসন) (শৃঙ্খলা ও তদন্ত শাখা), মো. শরিফ উদ্দিন (শৃঙ্খলা ও তদন্ত শাখা)। এমনকি তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিভিন্ন লোকের দোহাই দিয়ে অপকর্ম করে আসছেন। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় পূর্বের আন্দোলনকে স্থাগিত করেন সেখ মোহাম্মদ মহসিন।

অভিযোগ রয়েছে, সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করার পরেও তিনি অতিরিক্ত আরও ৩টি গাড়ি ব্যবহার করেন নিজ পরিবারের জন্য। যার প্রতিদিনের তেল, ড্রাইভারসহ যাবতীয় খরচ এলজিইডি থেকে বহন করা হচ্ছে। তিনি প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার পরে এখনো ১টিও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেননি, যে ২/১ টি প্রকল্প পাস হয়েছে সেগুলো আগের প্রকল্প।

জানা যায়, তিনি বেশ কিছু পদোন্নতি দিয়েছেন পিডি হিসেবে। অথচ ৯৪ ব্যাচের কর্মকর্তাদের দিয়ে তিনি নিয়ম বহির্ভুতভাবে নিজ এলাকার বেশ কিছু মসজিদ ও কবরস্থান নিয়েছেন সীতাকুণ্ডে, যা ডিপিপি বহির্ভূত। তিনি ক্ষমতার মদদে প্রথমেই আউট সোর্সিং নিয়োগ বন্ধ করেন, যা পূর্বের কোনো প্রধান প্রকৌশলী করেননি। তিনি নিজে এবং তার একটি সিন্ডিকিটের কাছে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ পিছিয়ে দিয়েছেন বলে বেশি ভাগ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অভিযোগ।

© 2022 payranews.com
Developed by- Payra Team