সোমবার | ১৩ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্যোগময় সভ্যতায় সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে হবে: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা অফিস: ইতিহাসে দু’বার এই উপমহাদেশে সামাজিক বিপ্লবের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমটি ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময়; দ্বিতীয়টি দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়। কিন্তু জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রবল হয়ে ওঠায় সামাজিক বিপ্লব সম্ভব হতে পারেনি।

সিপাহি বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ মহারানীর শাসন শুরু হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রথমে জনগণের থাকলেও পরে তা সামাজিক বিপ্লবের পথে না এগিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়।

পাকিস্তানের শাসকরা নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে এসে গণবিপ্লবের সম্ভাবনা প্রতিরোধ করেন। এর পর সত্তরের নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। সমাজতান্ত্রিক দলের বিভক্তি এবং পরিস্থিতির যথাযথ মূল্যায়ন করতে না পারার কারণে বিপ্লবী পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও সামাজিক বিপ্লব হতে পারেনি। মওলানা ভাসানী ছিলেন ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের উদ্‌গাতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এখান থেকে বীর হিসেবে বেরিয়ে আসেন।

স্বাধীনতার পর বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এলো। বিপ্লবের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তার মৃত্যু ঘটল। এখন দেশের পরিস্থিতি খুবই সংকটময়। সারাবিশ্বে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। যুদ্ধ, মাদক, পর্নোগ্রাফি, বর্ণবাদ মানবতার চারপাশে অন্ধকারকে গাঢ় করে তুলেছে। পৃথিবীর সামনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসেছে। একে ঠেকানো যাবে না। তবে প্রশ্ন হচ্ছে– এটি ব্যক্তিমালিকানায় থাকবে, নাকি সামাজিক মালিকানায়? মানবতার মুক্তির জন্য ব্যক্তিমালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানার দিকে যেতে হবে। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান সামাজিক বিপ্লবের যে সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল, মানুষের মুক্তি সে পথেই অনুসন্ধান করতে হবে।

ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল গণঅভ্যুত্থানের মূল বাণী। কিন্তু পরে রাষ্ট্রক্ষমতা পেল বুর্জোয়ারা। মানুষের ভেতর যে চেতনা এসেছিল, সেটির আর বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে আমরা কী পেলাম? দুটো সম্ভাবনা ছিল– একটি হচ্ছে স্বাধীনতা; অপরটি বিপ্লব। স্বাধীনতা এলো, কিন্তু বিপ্লবটা এলো না। ফলে যেটি ঘটল, বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে গেল। যে পরিবর্তন মানুষের চেতনার ভেতরে এসেছিল, সেই চেতনার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে; তা ঘটল না। তরুণরা সে সময় প্রতিবাদ করছিল বিভিন্ন অনিয়মের। কিন্তু তারা সমাজতন্ত্রের কথা বলছিল না। পরিবর্তন এসেছে, তবে সেটা হলো এ রকমের– যে তরুণ কবি কবিতা লিখেছিলেন একদা ‘বেশ্যার বিড়াল’ নিয়ে; সেই কবি স্বাধীনতার পরে ‘ভাত দে হারামজাদা’ লিখছেন। ‘ভাত দে হারামজাদা’ কোথা থেকে পেলেন তিনি? এটা পেলেন দেয়াল লিখন থেকে। এই পরিবর্তনটা ঘটেছে। কিন্তু আর এগোতে পারেননি।

ফররুখ আহমদ তাঁর কালের সবচেয়ে শক্তিশালী কবি। তিনি প্রথম জীবনে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতায় তীব্র ঘৃণা জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তানপন্থি হয়ে গেলেন। হায়াত দারাজ খান পাকিস্তানপন্থি হয়ে গেলেন। সৈয়দ আলী আহসান, যিনি প্রভাবশালী একজন অধ্যাপক ছিলেন, তিনি পাকিস্তান হওয়ার পর লিখেছেন– প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত বাদ দেব। কেননা, আমাদের কাছে রাষ্ট্রের সংহতি অনেক বেশি জরুরি। তিনি এও বলেছিলেন, আমি আমার আগের লেখাগুলো বর্জন করছি; ওগুলো অনুশীলন ছিল। তবে তাঁর মধ্যে পরিবর্তনটা ঘটছিল। তিনি খুবই সুন্দর একটা কবিতা লিখেছেন, ‘আমার পূর্ববাংলা’ নামে। কিন্তু সৈয়দ আলী আহসান অ্যান্টি কমিউনিস্ট ছিলেন, একেবারে শুরু থেকে। তিনি লিখেছেন অ্যান্টি ডুরিং নামে কবিতা, লাল বন্ধুদের জ্ঞান গ্রহণ করে কবিতা এবং যারা কাস্তে শান দিতে পারে তাদের কবিতা। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী হলেন, কিন্তু অ্যান্টি কমিউনিস্ট রয়ে গেলেন।

আমাদের উপমহাদেশে শ্রেণি সমস্যা ও জাতি সমস্যা রয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় জাতি সমস্যা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে ভ্রান্তি ঘটেছিল এভাবে– ভারতকে এক জাতির দেশ বলল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এর পর মুসলিম লীগ বলল, এখানে দুই জাতি আছে। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় জাতি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতা হলো। এর মধ্যে দেশভাগ হলো। দেশভাগ একটি বড় রকমের দুর্ঘটনা।

পাকিস্তান কী রকম অদ্ভুত রাষ্ট্র ছিল– দুই অঞ্চল বিশাল ব্যবধানে অবস্থিত, মধ্যখানে আরেক দেশ। আইয়ুব খানের দুশ্চিন্তা ছিল (পাকিস্তানের জনসংখ্যার) ৫৬ শতাংশ বাঙালি। জিন্নাহ সাহেব তখন পাকিস্তান নিয়ে দর-কষাকষি করছেন। তখন আরাকান ও ত্রিপুরা পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা ছিল। কলকাতা যে চলে গেল– এতে জিন্নাহর মাথাব্যথা ছিল না। কলকাতা থাকলে সেটা রাজধানী করার আলাপ উঠত। তা না হওয়ায় তিনি তাঁর জন্মভূমি করাচিকে রাজধানী করতে পারবেন।

এই উপমহাদেশ নদীর ওপর নির্ভরশীল। পাঞ্জাবে নদী আছে। সেগুলোর ব্যাপারে নেহরু অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। নদীর বিষয়ে র‍্যাডক্লিফকে প্রভাবিত করতে তিনি তৎপর ছিলেন। পূর্ববঙ্গের নদী নিয়ে পাকিস্তানের মাথাব্যথা ছিল না। মালদহ ও মুর্শিদাবাদ প্রথমে পাকিস্তানে আসার কথা ছিল। মুসলিমপ্রধান হিসেবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। এমনকি সেখানে পাকিস্তানের পতাকাও তোলা হয়েছিল। পরে দেখা গেল, সেটা ভারতে চলে গেল। কারণ ভারত এটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। বিশেষ করে গঙ্গা-পদ্মার ওপরে যে কর্তৃত্ব; এই দুই জেলা ধরে রাখার মধ্য দিয়ে তা সম্ভব ছিল। ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যেই পূর্ববঙ্গের প্রতি অবজ্ঞা দেখা যায়।

ব্যক্তিমালিকানার হাজার হাজার বছরের ইতিহাস পরিত্যাগ করতে হবে, সামাজিক মালিকানায় যেতে হবে। সামাজিক মালিকানায় না গেলে পৃথিবীতে মানুষ বসবাস করতে পারবে কি পারবে না, সেই সংশয় দেখা দেবে। এটা শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, প্রতিটি দেশে এ সমস্যা রয়েছে। সমস্যার সমাধান রয়েছে সামাজিক বিপ্লবে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সামাজিক বিপ্লবের সম্ভাবনা ছিল, এগিয়েও নিয়েছিল। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করা যায়নি। আজকে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ ব্যক্তিমালিকানার হাজার হাজার বছরের ইতিহাস বদল করে সামাজিক মালিকানায় নিয়ে যেতে চায়। আমি মনে করি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মূল বাণী– সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে হবে।

শুধু স্বাধীনতা নয়, প্রয়োজন রয়েছে বিপ্লবের। সেই বিপ্লব আইয়ুব খানের বিপ্লব নয়। এ বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব; মানুষের মুক্তির বিপ্লব। যে মুক্তির জন্য জনগণ পাকিস্তান চেয়েছিল, সেই পাকিস্তান হয়নি বলে তারা বিদ্রোহ করেছে। বাহান্নতে করেছে, ঊনসত্তরে করল, একাত্তরে যুদ্ধ করল, প্রাণ দিল। প্রাণ দিয়ে পাকিস্তানকে বিদায় করল, সেই রক্তগঙ্গা বয়ে গেল; যার কথা আইয়ুব বলেছিলেন। পাকিস্তান ভেঙে গেছে, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানও টিকবে না। এখন প্রয়োজন ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। এটি ছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মূল বাণী।

বিশ্ব একটি গভীর সংকট মোকাবিলা করছে। করোনা হলো সবচেয়ে বড় সংকট। এত বড় সংকট মানব সভ্যতার ইতিহাসে হয়তো আর দেখা যায়নি। হাজার হাজার বছর ধরে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সেই সভ্যতা যুদ্ধ, ধ্বংস, বর্ণবাদ এসবের মাধ্যমে ব্যবসা– এগুলো করবে! অন্ধকারকে আরও গাঢ় করবে, নাকি এ পৃথিবীকে বদল করার চেষ্টা করবে? এটি আজকে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আজকে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা শুনি। সেই বুদ্ধিমত্তা আসবে, কিন্তু তার মালিকানা কি ব্যক্তিগত থাকবে, নাকি সেটি সামাজিক হবে– এ প্রশ্ন আমাদের। এটি কি দৈত্যের মতো ধ্বংস করবে? এটি আমাদের বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রশ্নেরও জবাব আছে সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।

(২৩ জুন ২০২৩, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজের ৮৮তম জন্মদিন উপলক্ষে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান শীর্ষক যে একক বক্তব্য দিয়েছেন, তার সংক্ষিপ্ত রূপ)

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

© 2022 payranews.com
Developed by- Payra Team