সোমবার | ১৩ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সেন্টমার্টিন নিয়ে অহেতুক বিতর্ক

আরশাদ সিদ্দিকী

সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভবিতব্য নিয়ে রাজনীতির বাজার সরগরম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘যদি বলি সেন্টমার্টিন দ্বীপ কাউকে লিজ দেব, তাহলে আমার ক্ষমতায় থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমার দ্বারা সেটি হবে না।’ (সমকাল, ২১ জুন ২০২৩)।

জাতীয় সংসদে দুই বামপন্থি দলের নেতার ভাষ্যের সুরও ছিল প্রায় অভিন্ন। তাঁদের মতে, আমেরিকা সেন্টমার্টিন দ্বীপের জন্য ক্ষমতার পটপরিবর্তন চায়। অন্যদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকান দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। সেন্টমার্টিনসহ বাংলাদেশের কোনো জায়গা তারা চায়নি।

সেন্টমার্টিন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ‘রাজনৈতিক কৌশল’ বলে মন্তব্য করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘সেন্টমার্টিন’ লিজ দেওয়া না-দেওয়ার আলোচনা দেশের মানুষকে অসম্মান করার শামিল। রাজনৈতিক নেতারা দেশের জনগণের প্রতি আস্থা রাখার বদলে বিদেশিদের কূটচালের জালে বাঁধা পড়তেই যেন বেশি আগ্রহী।

তাঁদের বক্তব্য থেকে এ কথা ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে– জনগণের মতামত (ভোট) নয়; ক্ষমতার পালাবদলে ভিনদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে দেনা-পাওনার সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকের জন্য এ ভাবনা লজ্জা, অপমান ও অমর্যাদার। একই সঙ্গে দেশের জনগণের প্রতি অনাস্থারও প্রকাশ।

রাজনীতিবিদরা ভলোই জানেন, তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলে সবচেয়ে জরুরি জনগণের আস্থা অর্জন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরি, রক্ষা এবং উন্নয়নের কাজটিও জনগণকে আস্থায় রেখে করতে হয়। রাজনীতিবিদদের বক্তব্য যেন জনগণের মধ্যে অনাস্থা তৈরি না করে, সে দিকটিও তাঁদের বিবেচনায় নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া কোনো দেশের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশ্বের সব দেশই সর্বপ্রথম নিজেদের স্বার্থ দেখে। এখানে বিনা স্বার্থে কোনো দেশই অন্য দেশকে একবিন্দু ছাড় দেয় না। যত ছোট দেশই হোক; নিজেদের স্বার্থের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই তার। কারণ তারাও তাদের দেশের স্বার্থ রক্ষায় নিজ দেশের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ স্বার্থ রক্ষা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক– যে কোনো ধরনের হতে পারে। সারকথা হলো, পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষায় কে কতখানি লাভবান হচ্ছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্যও নিজের স্বার্থ রক্ষা করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখার কাজটি জরুরি। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘এ দেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে ক্ষমতায় আসতে চাই না।’

প্রশ্ন হলো, সম্পদ বিক্রি করে ক্ষমতায় আসার কথা আসছে কেন? তাহলে কি তিনি জনগণকে পরিপূর্ণ মাত্রায় আস্থায় নিতে পারছেন না? নাকি এমন কোনো বিদেশি চাপ তাঁকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা তিনি জনগণের কাছে প্রকাশ করতে পারছেন না? যদি এমন কোনো বিষয় তাঁর সামনে আসে, তবে দ্বিধাহীনভাবে তা জনগণের সামনে প্রকাশ করা উচিত। জনগণই তখন সিদ্ধান্ত নেবে– দেশের সম্পদ তারা কীভাবে রক্ষা করবে। এ কথাও সত্য, জনগণ কূটনৈতিক চাল রাজনীতিবিদদের মতো বোঝে না। তবে তারা কূটনৈতিক চালের ঊর্ধ্বে যা বোঝে তা হলো, দেশের স্বার্থ। এর সঙ্গে তার নিজের স্বার্থও জড়িত। তাই দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য যে কোনো কূটনৈতিক কৌশল মোকাবিলা করতে তারা প্রস্তুত।

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে পারে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তা খোলামেলাভাবে দেশের জনগণের সামনে উপস্থাপন করা উচিত। প্রয়োজন দেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতৈক্য তৈরি করা। রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধ স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে তারা একত্র হবে– এটাই জনগণের প্রত্যাশা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলও সেন্টমার্টিন ঘিরে বিতর্ককে ‘রাজনৈতিক কৌশল’ বলে এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাঁর উচিত ক্ষমতাসীন সকরারের প্রতি সরাসরি আহ্বান জানানো– দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে তাঁরা সরকারের সঙ্গে একত্র হয়ে তা প্রতিরোধ করবেন। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-অখণ্ডতা রক্ষার বিষয়টি ‘রাজনৈতিক কৌশল’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

যদিও সেন্টমার্টিন ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে অভিযোগের তীর বিএনপির দিকেই ছোড়া হয়েছে। তার জবাবও তারা দিয়েছে। তারা বলেছে, ‘বিএনপি কখনোই দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়নি।’ বিষয়টি বক্তব্য বা পাল্টা বক্তব্যের নয়; মতৈক্য তৈরির। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে রাজনীতির ময়দানে বক্তৃতার চেয়ে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নিজেদের সংহতি জানান দেওয়া বেশি কাজের।

দুর্ভাগ্য, এখানেও তারা পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়িতেই ব্যস্ত। ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়াই তাদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। তারা ভুলে যাচ্ছে– জনআস্থা অর্জন ছাড়া ক্ষমতার মসনদ নড়বড়ে এবং পরমুখাপেক্ষী থাকতে বাধ্য হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিদেশি শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

যদিও আমেরিকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘সেন্টমার্টিনসহ বাংলাদেশের কোনো জায়গা তারা চায়নি।’ তবু জনগণের মনে শঙ্কা রয়েই যায়। কারণ, হালের বিতর্কের আগেও সেন্টমার্টিন আলোচনায় এসেছে। বছরপাঁচেক আগে মিয়ানমার বারকয়েক সেন্টমার্টিনকে নিজেদের মানচিত্রে যুক্ত করে সরকারি ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করেছিল।

পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবাদের মুখে ভুল স্বীকার করে তারা বিনা শর্তে ওয়েবসাইট থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে নেয়। তারা বলেছিল, ভুলবশত এটি ঘটেছে। কিন্তু একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হলে তখন তাকে ‘ভুল’ না বলে দুরভিসন্ধি বলা ছাড়া উপায় থাকে না। তাই জনমনের শঙ্কাকেও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হয়।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির ময়দানে যেসব বিতর্ক উস্কে দেওয়া হচ্ছে, তা কতখানি যৌক্তিক ও বিবেচনাপ্রসূত, তা রাজনীতিবিদদের মাথায় রাখা দরকার। জনগণের ভোট পাওয়ার আশায় ‘দেশ বিক্রি’র মতো বক্তব্য বরং বুমেরাং হতে পারে।

জনগণের আস্থা ধরে রাখতে হলে রাজনীতিবিদদের যে কোনো বক্তব্য খোলামেলাভাবেই প্রকাশ করা উচিত। একই সঙ্গে জনগণের ওপর তাদের এ বিশ্বাসটুকু রাখতে হবে, সাধারণ জনগণ রাজনীতির মাঠে দক্ষ খেলোয়াড় নয়। তারা রাজনীতিবিদদের কথার মারপ্যাঁচের গভীরে যায় না; কিন্তু ধোঁয়াশা এবং সাদা বক্তব্যের ফারাকটুকু করতে পারে।

সেন্টমার্টিন নিয়ে যাঁরা বাজার সরগরমের চেষ্টা করছেন, তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন, পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে এটি যতখানি মূল্যবান, সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ততখানি নয়। এ নিয়ে বিতর্ক হয়তো অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বাকি পড়ে থাকবে।

তাই দেশ বিক্রির আলোচনা বাদ দিয়ে রাজনীতিবিদদের এ মুহূর্তের কাজ হবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদলের উপায় খোঁজা; যেন আর কখনও দেশ বিক্রি করে ক্ষমতায় আসার মতো বক্তব্য জনগণের সামনে না আসে।
দেশের কোন কোন বিষয়ে রাজনীতিবিদরা মতৈক্যে পৌঁছবেন, কোন কোন বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগ করে দেবেন, তা নির্ধারণ করা জরুরি। সে কাজগুলো করতে হলে তাঁদের এক টেবিলে আলোচনায় বসতে হবে, এমনও নয়। কেবল তাঁরা তাঁদের সামান্য মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিলেই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-অখণ্ডতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন তর্কগুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।

আরশাদ সিদ্দিকী: লেখক, গবেষক

© 2022 payranews.com
Developed by- Payra Team