রবিবার | ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবেদ চৌধুরীর সঙ্গে লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের মতবিনিময়

নিজস্ব প্রতিবেদক, নিউইয়র্ক অফিস: সাধারণত একবার রোপণে ধান গাছে একবার ফলন হয়। কিন্তু ফলন শেষ হওয়ার পর একটি ধান গাছ পুরোপুরি না কেটে একই গাছে বিভিন্ন মৌসুমের উপযোগী আরও চার রকমের ধান কীভাবে উৎপাদন সম্ভব তা আবিষ্কার করেছেন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী।

তিনি তার এ আবিষ্কারের নাম দিয়েছেন ‘পঞ্চব্রীহি’। আর এই ধান নিয়ে বৃহস্পতিবার লন্ডন-বাংলা প্রেসক্লাব ‘ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড হিউম্যান হেল্থ’ শিরোনামে এক মতবিনিময় সভায় আয়োজন করে। সেখানে সাংবাদিকদের তার আবিষ্কারের কথা জানান তিনি।

লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং ক্লাবের সেক্রেটারি তাইসির মাহমুদের পরিচালনায় মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের বাইয়োলোজি, প্ল্যান্ট সাইন্সেস অ্যান্ড জোলোজি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর হুঘ ডিকিনসন এবং জেনোফ্যাক্সের সিইও জাহাঙ্গির আলম।

প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত, বন্যাপ্রবণ ও খরাপীড়িত দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংকট দূরীকরণে নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। মতবিনিময় সভায় ড. আবেদ চৌধুরীর জানান, ‘এই নতুন ধান চাষ পদ্ধতি যদি সারাদেশের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য গোটা জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব’।

ড. চৌধুরী আরও জানান, সিলেটের একটি অঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে কোনো রাসায়নিক ছাড়াই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির ধানের মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি পাঁচ রকমের ধান গাছ আবিষ্কার করেছেন। যা চাষের জন্য নতুন করে পাঁচ রকমের ধান গাছ রোপণ করতে হবে না। এতে কৃষকের সময় যেমন বাঁচবে, তেমনি সাশ্রয় হবে অর্থও। একইসঙ্গে একই জমিতে একই গাছে পাঁচ রকমের ধান উৎপাদনের ফলে দূর হবে দেশের খাদ্য সংকট।

পূর্ব লন্ডনের এন্টারপ্রাইজ একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত ওই মতবিনিময় সভায় ড. আবেদ চৌধুরী তার এ আবিষ্কারের কাহিনি উপস্থাপনের পর গভীর মনযোগের সঙ্গে এ নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্ন শোনেন এবং প্রতিটি প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর দেন।

তার এ নতুন ধান উৎপাদন পদ্ধতি বাণিজ্যিক উপায়ে ব্যবহার করা হবে, না কী সাধারণের মাঝে বিনামূল্যে ছড়িয়ে দেওয়া হবে এ প্রশ্নের উত্তরে ডক্টর চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা শেষে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আমার এ আবিষ্কারকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করব না, এটিকে সহজলভ্য করে দেব আমার দেশের দরিদ্র কৃষকদের জন্য’।

ড. চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমার এ আবিষ্কারের গবেষণাগার হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত সিলেটের একটি গ্রাম, যে গ্রামে আমি বড় হয়েছি। সেখানে আমার গবেষণার সহযোগী ছিলেন সেসব নিরক্ষর কৃষক যাদের গায়ে লেগে থাকে বাংলার জল-কাদার গন্ধ। তারা দীর্ঘদিন ধরে মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দিনরাত আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তাদের বুকে মিশে আছে ধর্ম ও বিজ্ঞান। এসব নিরক্ষর, সরলপ্রাণ, দেশপ্রেমিক কৃষককে সঙ্গে নিয়ে আমি বিশ্বকে উপহার দিতে চাই উৎপাদনের শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞান। আমি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আমার আবিষ্কারকে ব্যবহার করতে চাই না। আমি চাই আমার এ আবিষ্কার দেশের মানুষের জীবনমান বদলে দিক। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক আমার মাতৃভূমির মানুষের জন্য।

গবেষক ড. আবেদ চৌধুরীর বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামে। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধান বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। প্রবাসে থাকলেও দেশের ধানের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন তিনি। নিজের উদ্ভাবিত জাতের ধান উৎপাদনে জন্মস্থান কানিহাটি গ্রামের পারিবারিক জমিতে গড়ে তুলেছেন খামার।

পঞ্চব্রীহি ধানের পেছনের গল্প বলতে গিয়ে ড. আবেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমি দেখেছি বাংলাদেশে যারা ধান চাষ করেন, তারা উন্নত জীবনযাপন করতে পারেন না। তাদের খরচ অনেক বেশি, খরচ করার পর যা ধান পান, ওটা বিক্রি করে তো পোষায় না। যারা ধানের উপর নির্ভরশীল, তারা দরিদ্র থেকেই যান। ধান বিক্রির টাকা, উৎপাদন খরচ দিয়ে খেয়ে-পড়ে ভালোভাবে বাঁচতে পারেন না। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না। এটাই বাস্তবতা। এটা আমার জন্য খুব পীড়া দায়ক ছিল।’

তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষিনির্ভর পরিবারকে দেখেছি দেশে খুব অবহেলিত। মানুষ শুধু চায় কমদামে ধান পেতে। কিন্তু কৃষকরা যে মূল্য পাচ্ছে না, সেটা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি আমার ব্যক্তিগতভাবে কৃষিতে কিভাবে আয় বাড়ানো যায়, ব্যয় কমানো যায়, এটা নিয়ে আমি সারাক্ষণ চিন্তা করি। একটা ধান জমিতে থাকবে, বিশাল আকার ধারণ করে অনেক অনেক ধান দেবে। আমি এই জিনিসটাই করতে চেয়েছি, অত্যন্ত আনন্দের বিষয়, আমি করতে পেরেছি।’

ধানের নাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একে ব্রীহি বলা হয়। এটা যেহেতু পাঁচবার ফলন দিয়েছে, তাই আপাতত এর নাম পঞ্চব্রীহি রেখেছি। পরবর্তীতে চিন্তা ভাবনা করে নাম নির্ধারণ করবো। ‘ষষ্ঠবার ফলনে সফল হলে এই জাতের নামকরণ ‘ষষ্ঠব্রীহি’ করা যেতে পারে। আবার ‘বর্ষব্রীহি’ বলা যায়, যেহেতু বছরজুড়ে ফলন হয়। ‘পঞ্চব্রীহি’ চাষের মাধ্যমে একটি ধান গাছ থেকে একটি বোরো, দু’টি আমন ও দু’টি আউশ পাওয়া সম্ভব।

 

© 2022 payranews.com
Developed by- Payra Team